অপরিকল্পিতভাবে খুলনা মহানগরী গড়ে ওঠায় এর ফল ভোগ করতে শুরু করেছে নগরবাসী। ইতোমধ্যে যত্রতত্র ভবন নির্মাণের সুযোগ দেওয়া ও অপ্রশস্ত রাস্তা নির্মাণে যানজট বাড়ছে। খালগুলো দখল হয়ে যাওয়া এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থার অভাবে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ বাড়াচ্ছে। ময়লার ডাম্পিং স্টেশনগুলো শহরের মধ্যে হওয়ায় বাড়ছে দূষণ। কেডিএ, কেসিসি, ওয়াসা ও বিদ্যুৎ বিভাগসহ সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে উন্নয়ন কর্মকান্ডে সমন্বয়হীনতা দৃশ্যমান। নাগরিক নেতারা বলছেন, সমন্বয়ের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা না থাকলে আগামীর জন্য দুর্বিষহ হবে এ নগর।
খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনা সিটি কর্পোরেশন, বিদ্যুৎ বিভাগ, জেলা পরিষদ ও এলজিইডিসহ নগর উন্নয়নে নিয়োজিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং ‘একলা চলো নীতির কারণে’ খুলনার অর্থনৈতিক গুরুত্ব যথাযথভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। সম্পদ ও ভূমির যথাযথ ব্যবহার না হওয়ায় অপচয় হচ্ছে। কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের। স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। সর্বোপরি নগরবাসীর আবাসন, বিদ্যুৎ, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, রাস্তা-ঘাটসহ নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ।
অপ্রশস্ত সড়ক ও যত্রতত্র ভবন নির্মাণ : নগরীর প্রাণকেন্দ্রে খানজাহান আলী সড়কটি মূল অংশ থেকে ছোট হয়ে পড়েছে। দুই পাশে দখলদারদের কারণে এ অবস্থা। টুটপাড়া কবরখানা থেকে ফেরিঘাট মোড় পর্যন্ত দিন রাত যানজট লেগেই থাকে। এরমধ্যে নগরীর অন্যতম ব্যস্ততম জায়গা শান্তিধাম মোড়ের ওপরেই একটি ১০ তলা ভবনের অনুমোদন দেয় কেডিএ। ফলে এ জায়গায় সকাল ১০ টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত থাকে যানজট। একই অবস্থা ময়লাপোতা মোড়েও। সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করে হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে। কেডিএ সুদূরপ্রসারি চিন্তা ছাড়াই এর অনুমোদন দিয়েছে। খুলনায় ৫ ফুট রাস্তা ছেড়ে বাড়ি তৈরির নিয়ম থাকলেও সেটি মানছে না বাড়ির মালিক। কেডিএ’র কোন তদারকিও নেই এ বিষয়ে।
খুলনায় গত দুই দশকে বেশ কয়েকটি বড় বড় সড়ক নির্মাণ হয়েছে। সোনাডাঙ্গা-গল্লামারি, এম এ বারী লিঙ্ক রোড, সোনাডাঙ্গা- নতুন রাস্তা মুজগুন্নী মহাসড়ক ও আবু নাসের হাসপাতাল-বাইপাস সড়ক উল্লেখযোগ্য। অভিযোগ উঠেছে, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কিছু সড়ক নির্মাণ করেছে মানহীনভাবে। পরবর্তিতে এর রক্ষণাবেক্ষনের জন্য কেসিসি’র নিকট হস্তান্তর করলেও ভগ্নদশার কারণে কেসিসি দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। কেসিসির পরিকল্পনাবিদ আবিরুল জব্বার বলেন, ‘সড়ক নির্মাণের মান এত খারাপ যে বছর খানেকের মধ্যেই এসব সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। যদিও একই অভিযোগ কেসিসি’র বিরুদ্ধেও রয়েছে।
জলাবদ্ধতা ও খাল দখল : খুলনা মহানগরীকে জালের মত করে ঘিরে রেখেছে ২২টি খাল। দখলে যার বেশিভাগেরই আয়তন সংকুচিত হয়েছে। খালগুলোর যখন এই অবস্থা তখন শহরে পানির চাপ বাড়ে। ফলে তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। নগরীর পাশে একমাত্র ময়ুর নদটি খননের পরেও নোংরা পরিবেশ ও নগরীর পানি নিষ্কাসনে ভূমিকা রাখতে পারছে না। ২০০৯ সালে খালের দখলদারদের একটি তালিকা তৈরি করা হয় কেসিসির পক্ষ থেকে। ওই তালিকায় শহর ও শহরতলির ৫০টি খাল দখলের সঙ্গে ৮১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের যুক্ত থাকার তথ্য উঠে আসে। ওই তালিকায় দেখা যায় ৫০টি খালের মধ্যে ১১টির কোনো অস্তিত্ব নেই। বাকি ৩৯টি খালের অন্ততঃ ৭০ শতাংশ অবৈধ দখলে রয়েছে।
২০১১ সালে নগরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে একটি মাস্টারপ্লান অনুমোদন হয়। সেখানে ১ হাজার ১৬৫ কিলোমিটার নর্দমা নির্মাণ ও খালগুলো পুনঃখনন, ৪টি শক্তিশালী পাম্প হাউস স্থাপন ও ৩৫ কিলোমিটার শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণের বিষয় উল্লেখ করা হয়। এটি বাস্তবায়নে ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। কেসিসির পরিকল্পনাবিদ আবিরুল জব্বার বলেন, ‘পরীক্ষামূলকভাবে ১২টি খাল, কয়েকটি ড্রেন নির্মাণ ও ও ১০ কিলোমিটার শহর রক্ষাবাঁধের কাজ শেষ হয়েছে। যা মোট কাজের তিন শতাংশ মাত্র। মাস্টার প্লানের প্রথম পর্যায়ের কাজ চলমান। এর মধ্যে ১০ টি খাল, ৮০ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ, চারটি পাম্প হাউস, ৩টি স্লুইসগেটের উন্নয়নের কাজ রাখা আছে। যা বাস্তবায়ন হলে জলাবদ্ধতা থাকবে না।’
সমন্বয়হীন উন্নয়ন পরিকল্পনা : উন্নয়ন পরিকল্পনায় সমন্বয় নেই সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যেও। খুলনা সিটি কর্পোরেশনের অভিযোগ, পরিকল্পিত রাস্তা ও ড্রেন ছাড়াই যত্রতত্র ভবন গড়ে উঠেছে। কেডিএর তৈরি আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকাগুলোও নির্মাণ করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। সোনাডাঙ্গা ও নিরালা আবাসিক এলাকার একটি ফেজেও গৃহস্থালি বর্জ্য ফেলার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। মুজগুন্নী মহাসড়কের দুই পাশে বাণিজ্যিক প্লট তৈরি করলেও মূল সড়কে আসার জন্য কোনো সংযোগ সড়ক তৈরি করেনি কেডিএ। নির্মাণ করেনি ড্রেনও। দৌলতপুরে কেডিএ’র কল্পতরু মার্কেট এখন মাদকসেবীদের দখলে, রূপসায় কেডিএ মার্কেটের অবস্থা জরাজীর্ণ এবং নিউ মার্কেটের পেছনের সড়কটি ড্রেন ছাড়া ও ভাঙাচোরা। সম্প্রতি কেডিএ’র ময়ূরী আবাসিকের অবরাদ্দকৃত ৩১টি প্লট সংস্থাটি নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে। এসব উন্নয়নে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে কেডিএর কাজের সমন্বহীনতার কারণে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন খুলনার নাগরিক নেতারা।
সমন্বয়হীন উন্নয়নের বিষয়ে খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, নগরী জুড়ে সারা বছর খোঁড়াখুড়ি লেগে থাকে। কেডিএ, ওয়াসার পাইপ লাইন, টেলিফোন লাইন, বিদ্যুৎ, সওজ ও কেসিসির সড়ক নির্মাণ কাজে পৃথক পৃথকভাবে কাজ হয়। এতে অর্থের যেমন অপচয়, তেমনি ভোগান্তি বাড়ে মানুষের। আগামীর খুলনা গড়তে সব প্রতিষ্ঠানগুলোর সু-সমন্বয়ের মাধ্যমে উন্নয়ন করতে হবে। নতুন নতুন আবাসিক প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সেসব জায়গায় নাগরিক সুবিধার বিষয়টি গুরুত্বহীন থাকছে। বিল্ডিং কোড মেনে বাড়ি তৈরি হচ্ছে না। রাস্তা সংকুচিত হচ্ছে। বিনোদনের ব্যবস্থাও রাখা হচ্ছে না। ফলে নাগরিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে খুলনাবাসী।
খুলনা গেজেট/এমএইচবি