মানুষের কত রকম শখ আছে। কারও কৃষি কাজ, কারও পাখি পালন করতে ভালো লাগে, কারও ফুল চাষ করতে ভালো
লাগে, আবার কারও অ্যাকুরিয়ামে রঙিন মাছ চাষ করতে ভাল লাগে। কিন্তু কখনও কখনও এই সৌখিন বিষয়টি হয়ে ওঠে জীবন সংসারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক।
এমন একজন সৌখিন মানুষ রয়েছে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার ব্রজবাকসা গ্রামের মৃত.আব্দুল হাকিমের বড় ছেলে সাইফুল্লাহ গাজি। তিনি রঙিন মাছ চাষ করে পাল্টে নিয়েছে তার জীবন-জীবিকা। অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি তাকে দেশব্যাপী পরিচিতিও এনে দিয়েছে। এখন তাকে সবাই এক নামে চেনেন ‘রঙিন মাছের কারিগর’ হিসেবে। তার হ্যাচারির পানিতে ভাসছে নানা রঙের মাছ। লাল, নীল, কমলা, কালো, বাদামি, হলুদ রঙের মাছের ছড়াছড়ি। গোল্ড ফিশ, কমেট, কই কার্ভ, ওরেন্টা গোল্ড, সিল্কি কই, মলি, গাপটি, অ্যাঞ্জেল প্রভৃতি বর্ণিল মাছ দেখলে চোখ জুড়িয়ে মন ভরে যায়। কলারোয়ার এই তরুণ উদ্যোক্তা সাইফুল্লাহ গাজী রঙিন মাছের চাষ তার জীবনকে রাঙিয়ে দিয়েছে। সাইফুল্লাহ মাত্র ৬২০ টাকায় অ্যাকুরিয়াম মাছের চাষ শুরু করেন। আর সেই মাছ চাষ তাকে আজ বানিয়েছে কোটিপতি।
এক সময় বিদেশ থেকে আমদানি করা অ্যাকুরিয়ার মাছ সৌখিন ব্যক্তিদের বাসা-বাড়িতে শোভা পেত। কিন্তু উদ্যোমী সাইফুল্লাহ’র চেষ্টায় দেশ থেকে উৎপাদিত মাছ এখন সৌখিনদের বাসা-বাড়িতে যাচ্ছে। বর্তমানে দেড় কোটি টাকার
মূলধন খাটিয়ে ব্যবসা করছেন সাইফুল্লাহ গাজী। যিনি সাতক্ষীরার কলারোয়ার বজ্রবকসা গ্রামের বাসিন্দা। বর্তমানে ২০টি পুকুরে বিভিন্ন প্রকারের অ্যাকুরিয়ামের মাছ চাষ করছেন তিনি। বিশাল মূলধন খাটানোর পাশপাশি ৫০জন বেকারের কর্মসংস্থান করেছেন এই সাইফুল্লাহ গাজী। তার পুকুরে বাহারি রঙের মাছের সমারোহ দেখা গেছে। প্রতিদিন সকালে পাত্রে শব্দ করে মাছকে খাবার দেন সাইফুল্লাহ। শব্দ শুনে পুকুরের এক কিনারে জমা হয় সব রঙিন মাছ। এরপর খাবার ছিটিয়ে দিলেই নিমিষেই খাবার খেয়ে তৃপ্ত হয় মাছগুলো।
সফল উদ্যোক্তা সাইফুল্লাহ গাজী বলেন, আমার পিতা-মাতার ৭ ছেলে-মেয়ের মধ্যে আমি বড় ছেলে। পিতার সংসারে খুবই অভাব থাকার কারণে বেশী লেখাপড়া করতে পারেনি। একপর্যায়ে ১৯৯৭ সালে অভাবের তাড়নায় জেদের বশবতী হয়ে প্রতিবেশি দেশ ভারতে কাজে যাই। সেখানে টেক্সটাইল মিলে কাজ করার পাশাপাশি একটি গ্রামীণ এলাকায় যাই। সেখানে বেশ কয়েকটি পুকুরে নানা রঙের মাছ চাষ দেখতে পাই। এর পরে ২বছর ৭মাস পর ১৯৯৯ সালে দেশে ফিরে এসে রঙিন মাসের চাষ নিয়ে বাড়িতে আলাপ- আলোচনা শুরু করি। কিন্তু প্রথমে আমার পিতাসহ বাড়ীতে কেউ সম্মতি দেয়নি। এরপর অভাবের সাথে লড়াই করে না পেরে ওই বছরেই আবারো বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টেসে কাজ শুরু করি। কিন্তু পর্যাপ্ত আয় না থাকায় সন্তুষ্টি মেলেনি। তখন ঢাকার মিরপুর-১৩ নম্বরের একটি দোকানে অ্যাকুরিয়াম দেখি। ভারত থেকে সৃষ্ট আকাঙ্খা আর মিরপুরের দোকান দেখে অ্যাকুরিয়াম মাছ চাষের প্রতি প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তবে আগ্রহ থাকলেও মূলধন ছিল না। মাসের বেতনের সব টাকা খরচ করে
অবশিষ্ট ৬২০ টাকা ছিল। সেই টাকায় পরেশ নামের এক বন্ধুর নিকট থেকে ২০০৪ সালে কয়েকটি মাছ নিয়ে বাড়িতে রওনা হই। বাড়িতে অ্যাকুরিয়ামের মাছগুলোকে এনে মাটিতে রিং স্লাফ বসিয়ে পালন শুরু করি। এক সময় মাছগুলো ডিম দেয়। কিন্তু পুরুষ মাছের অভাবে ডিমগুলো থেকে বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছিল না। তারপরে পুরুষ যোগাড় করে বাচ্চা উৎপাদন শুরু করি। এভাবেই অ্যাকুরিয়াম মাছ চাষ শুরু করি।
তিনি আরও বলেন, ৫ বছরের অক্লান্ত সাধনায় ৯ ধরনের মাছ প্রস্তুত করতে সক্ষম হই। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ৬২০ টাকার মূলধন এখন দেড় কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ২০টি পুকুর এবং ৮৮টি হাউজে ২৬ প্রজাতির মাছ চাষ করা অ্যাকুরিয়ামের পেছনে এখন ৫০জন শ্রমিক কাজ করছেন। আমার চাষ করা অ্যাকুরিয়াম মাছ ঢাকার কাঁটাবন, খুলনা ও রাজশাহীসহ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশ রফতানি করার ইচ্ছা রয়েছে তার। এতে নিজে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি দেশ লাভবান হবে। তবে রঙিন মাছ চাষ এখন কেবল সাতক্ষীরা অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ না। ফেনী, ময়মনসিংহ ও
ফরিদপুরেও বাণিজ্যিকভাবে রঙিন মাছের চাষ হচ্ছে। এছাড়া অনেকে বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে বাসার ছাদেও রঙিন মাছের চাষ করে তা বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করছেন। বাংলাদেশে অ্যাকুরিয়ামে রঙিন মাছ ব্যাপক জনপ্রিয়। শৌখিন মানুষ বাসা-বাড়িতে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য অ্যাকুরিয়াম রাখেন। শপিংমল, হোটেল, রেস্টুরেন্ট এমনকি দোকানেও এখন অ্যাকুরিয়ামের ব্যবহার বেড়েছে।
সাইফুল্লাহ গাজী জানান, ২০১৪ সালে পুকুর লিজ নিয়ে বেশি করে রঙিন মাছ চাষ শুরু করি। বিশেষ পদ্ধতিতে উৎপাদন করা মিল্কি কই কার্প, কিচিং গোরামি, কই কার্প, কমিটিসহ ২৫ থেকে ২৬ প্রজাতির রঙিন মাছ উৎপাদন হচ্ছে। এই মাছ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হচ্ছে।
সাইফুল্লাহ বলেন, রঙ বদলিয়ে সিল্কি নামের একটি মাছ তৈরি করছি। অনেকটা জরির মতোই দেখতে। সে জন্যই নাম দিয়েছি সিল্কি। রঙ পরিবর্তন করা এ মাছের চাহিদাও রয়েছে। তবে প্রযুক্তির অভাবে পরিপূর্ণ চাষ করতে পারছি না। সরকারের তরফ থেকে ওই সমস্ত প্রযুক্তি পেলে আমি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানী করতে পারতাম।
সাইফুল্লাহ বলেন, বর্তমানে ২০টি পুকুর লিজ নিয়ে রঙিন মাছ চাষ করছি। প্রতিটি মাছ সর্বনিম্ন ১০ টাকা আর সর্বোচ্চ ১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এই ব্যবসাকে ঘিরেই বড় ছেলের নামে ‘রেজা অ্যাকুরিয়াম ফিস’ নামের একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান শুরু করেছি।
সাইফুল্লাহ’র স্ত্রী জেসমিন সুলতানা বললেন, ২০০৪ সালে মাত্র ছয় জোড়া পোনা মাছ দিয়ে আমরা চাষ শুরু করি। সেই থেকে স্বামীর সঙ্গে মাছ চাষে সহযোগিতা করে আসছি।
এ বিষয়ে কলারোয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রবীন্দ্রনাথ এই উদ্যোগকে ভালো উল্লেখ করে বলেন, এর চাষ প্রণালি অন্য মাছের মতো। শুধু আলাদা কিছু খাবার দিতে হয়। তবে এই রঙিন মাছের চাহিদা থাকায় খামারিরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। আমরাও চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।
খুলনা গেজেট/ টি আই