টেকসই বেড়িবাঁধের জন্য কয়েক যুগ অপেক্ষা করছে খুলনা উপকূলের মানুষ। দীর্ঘ দাবি-দাওয়ার পর ঝড় আর জোয়ারে ভাসা উপক‚লের মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় এগিয়ে আসে বিশ্বব্যাংক। প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে পুন:নির্মাণ হয় খুলনার দাকোপ উপকূলের দুটি বাঁধ (৩২ ও ৩৩নং পোল্ডার)। গত ৩০ জুন কাঙ্খিত সেই বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে।
অথচ কাজ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই ধসে যাচ্ছে নতুন বাঁধ। গত আগস্ট মাসে দাকোপ উপজেলার ৩২ নম্বর পোল্ডারের একাধিক জায়গায় বাঁধ ধসে গেছে। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে আরও ৫টি এলাকা। সর্বশেষ গত ১৫ সেপ্টেম্বর বাজুয়া ইউনিয়নের চুনকুড়ি খেয়াঘাটের পাশে ১০০ মিটার বাঁধ (৩৩নং পোল্ডার) নদীতে ধসে যায়। এতে দোকানপাটসহ বেশকিছু ঘর চুনকুড়িতে ভেসে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, বাঁধের কাজ শুরু হওয়ার পর আশায় বুক বেধেঁছিলেন তারা। কিন্তু যতো বড় প্রকল্প, কাজ ততো ভালো হয়নি। বেশিরভাগ স্থানে পুরাতন বাঁধের ওপর মাটি দিয়ে নতুন বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পেলেও প্রায় এলাকায় কাজ করেছে, তাদের নিয়োগকৃত দেশীয় উপ-ঠিকাদাররা। সেই কাজেও মনিটরিং ব্যবস্থা ছিলো দুর্বল।
তারা জানান, এতো টাকা খরচের আগে নদী ভাঙনের বিষয়টিকে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বাঁধ নির্মাণের কাজ চলা অবস্থায় গ্রামের মানুষ ও জনপ্রতিনিধিরা একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন করে নদী শাসনের (কংক্রিটের ব্লক ফেলে নদী ভাঙন ঠেকানো) দাবি তোলেন।
তাদের ভাষ্য ছিলো, উপকূলের খরস্রোত নদীগুলো শাসন না করে বাঁধ নির্মাণ করলে এই বাঁধ টিকবে না। বাঁধের পেছনে শত কোটি টাকা খরচের আগে নদী শাসন জরুরী। কিন্তু ওই অঞ্চলের পানি-মাটিতে বেড়ে ওঠা গ্রামের মানুষের কথাকে গুরুত্ব দেননি রাজধানীতে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা।
তবে কাজ শেষ হওয়ার মাত্র দুই মাসের মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন দেখা দেওয়ায় টনক নড়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের। বাঁধের ভাঙন ঠেকাতে এখন নদী শাসনের নতুন প্রকল্প নিচ্ছে সংস্থাটি। ভাঙন কবলিত ৭ কিলোমিটার অংশে নদী শাসন করতে আপাতত ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫২ কোটি টাকা। এই ব্যয় আরও বাড়তে পারে।
গত কয়েকদিন ওই এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেছে এ প্রতিবেদক। উপক‚লীয় এলাকার মানুষ এখনও বলছেন, মাত্র ৭ কিলোমিটার অংশ নদী শাসন করে পুরো বাঁধ রক্ষা করা সম্ভব নয়। কারণ প্রতিবছরই নতুন জায়গায় বাঁধ ভাঙছে। কিছু এলাকায় নদী শাসন করলে অন্য এলাকায় ভাঙন বাড়বে কিনা, তা নিয়েও কোনো সমীক্ষা হয়নি। সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকার এই বাঁধ, উপক‚লের মানুষ ও সম্পদ বাঁচাতে ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিটি অংশে নদী শাসন জরুরী। পাশাপাশি যে সব এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে, ওই অংশ দ্রুত মেরামত করতে হবে। কিন্তু এবারও স্থানীয়দের কথা কানে তুলছেন না কর্মকর্তারা।
প্রকল্পের যা হয়েছে
খুলনাসহ উপকূলীয় ৬টি জেলার টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৩ সালে। উপক‚লীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প (সিইআইপি) ফেজ-১ নামের এই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে বিশ্ব ব্যাংক। প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজার ২৮০ কোটি টাকা দিয়ে ১৭টি বাঁধ (পোল্ডার) নির্মাণ করা হয়েছে।
এর আওতায় খুলনার দাকোপ উপজেলার ৩২নং পোল্ডারে ৪৯ দশমিক ৬৬ কিলোমিটার এবং ৩৩নং পোল্ডারে প্রায় ৫০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১৭ সালে শুরু হওয়ায় এই কাজ শেষ হয়েছে গত ৩০ জুন। খুলনার অংশে প্রকল্প ব্যয় প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা।
বাঁধ নির্মাণ ছাড়াও প্রকল্পের আওতায় ৩২নং পোল্ডারে ১৫টি কালভার্ট ও স্লুইচ গেট নির্মাণ, ৩ দশমিক ৩০০ কিলোমিটার বাঁধের ঢাল সংরক্ষণ, ১৭ কিলোমিটার খাল খনন এবং ২ কিলোমিটার নদী শাসন করা হয়েছে। ৩৩নং পোল্ডারে বাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি ৬২ কিলোমিটার খাল খনন, ২১টি কালভার্ট ও স্লুইচ গেট, ৪ কিলোমিটার ঢাল সংরক্ষণ এব ১ দশমিক ৩০০ কিলোমিটার নদী শাসন করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিবেদন বলছে, গত ৩০ জুনের মধ্যে ৩২ নম্বর পোল্ডারের ৯৮ দশমিক ২০ শতাংশ এবং ৩৩ নম্বর পোল্ডারের ৯৯ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।
তিন মাসেই বাঁধে ধস
সম্প্রতি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কাজ শেষ হওয়ার তিন মাস যেতে না যেতেই বাঁধের বিভিন্ন অংশ বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। ওই সব এলাকায় বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে বাঁধের ভাঙন রক্ষায় কাজ করছে পরামর্শক সংস্থা।
স্থানীয়রা জানান, গত ২৪ আগস্ট গুনারী কালিবাড়ি অংশে ৫০ মিটার ধসে যায়। এর আগে ধসে গেছে পাশের ১০০ মিটার বিভিন্ন অংশ। ধসে যাওয়া অংশের দুই পাশে মাটিতে বড় ধরনের ফাটল ধরেছে। ভাঙন ধরেছে গুনারী, কালীবাড়ী, নলিয়ান, জালিয়াখালী, কালাবগী, সুতারখালী, কামারখোলা জোড়াগেট এলাকায়। দ্রæত ভাঙন ঠেকাতে পদক্ষেপ নেওয়া না হলে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
স্থানীয়রা আরও জানান, কাজ চলা অবস্থায় অনেক এলাকায় বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। গত বছর কালাবাগী গ্রামের বৃহস্পতি বাজারের কিছুটা উত্তর দিকে বাউলি বাড়ির সামনে বাঁধের ৫০ থেকে ৬০ হাত সুতারখালী নদীতে বিলীন হয়ে যায়।
এতোদিন ভাঙন ছিলো শুধু ৩২নং পোল্ডারে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ৩৩নং পোল্ডারেও ভাঙন শুরু হয়েছে। বাজুয়া ইউনিয়নের চুনকুড়ি খেয়াঘাটের পাশে ১০০ মিটার বাঁধ নদীতে ধসে যায়।
বাঁধ ঘুরে দেখার সময় নদীতে জোয়ার ছিলো। সুতারখালী ইউনিয়নের তেলিখালী স্থানে ভরা জোয়ারে বাঁধের ৪/৫ ফুট পর্যন্ত পানি উঠে যায়। নদীর তলদেশ ভরাট এবং জোয়ারের উচ্চতা বাড়তে থাকায় কয়েক বছর পরে এই বাঁধ জোয়ার থেকে এলাকা বাঁচাতে পারবে কি-না তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন গ্রামের মানুষ।
বাঁধ নিয়ে হতাশ স্থানীয়রা
এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নতুন দুটি বাঁধের সবচেয়ে বেশি ভেঙেছে ৩২নম্বর পোল্ডার। এই বাঁধের ভেতরে সুতারখালী ও কামারখোলা ইউনিয়নের প্রায় ৬০ হাজার মানুষের বসবাস। দীপ ইউনিয়ন দুটি চারপাশেই খর¯্রােতা শিবসা, ভদ্রা, ঢাকী ও সুতারখালী নদী। বাঁধের একটি অংশ ভাঙলেই দুটো ইউনিয়নের মানুষ, হাজার কোটি টাকার সম্পদ নোনা পানিতে তলিয়ে যাবে। এজন্য যে কোনো একটি স্থানে ভাঙন ধরলে আতংকে ভোগেন সব মানুষ।
সুতারখালী পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি নিরেন্দু মন্ডল বলেন, বেড়িবাঁধের কাজ শুরু হলে আমরা এলাকার মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কিন্তু কাজ শুরুর পর আমরা হতাশ হয়েছি। কিছু এলাকায় ভালো কাজ হয়েছে, কিছু এলাকায় যাচ্ছে তাই। আমার বাড়ির সামনেই পুরাতন বাঁধের দু’পাশে মাটি দিয়ে কোনো রকম কাজ করেছে।
তিনি বলেন, আমার বাড়ি, তেলিখালী বাজারে সামনে বালু দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করেছে। আমি প্রতিবাদ করায় আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের জানিয়েও কাজ হয়নি।
দাকোপ উপজেলার গুনারী শীতল চন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আদিত্য নারায়ণ সরদার বলেন, নতুন এই বাঁধ নিয়ে আমাদের সবারই স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, কাজ শুরুর সময়ই নদী শাসনের দাবিতে আমরা আন্দোলন করেছি। কিন্তু আমাদের কথা শুনলো না। কোটি কোটি টাকা খরচের পর সেই টাকা পানিতে চলে যাচ্ছে। নদী শাসন না করলে যতো টাকাই খরচ করুক, বাঁধ টেকানো যাবে না।
সুতারখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুম আলী ফকির বলেন, বাঁধে ধস লাগলে আমরা পাউবো কর্মকর্তাদের খবর দেই। কালিবাড়ি এলাকায় বাঁধ ধসার খবর আগে জানিয়েছি, তারা গুরুত্ব দেয়নি। বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পাউবোর লোকেরা এলাকায় আসেন না।
পানি উন্নয়ন বোর্ড যা বলছে
উপক‚লীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিইআইপি) নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে খুলনায় দায়িত্ব পালন করছেন আশরাফুল আলম। তিনি বলেন, এই অঞ্চলের নদীর গতি প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রকল্পের সমীক্ষা করা হয়েছিল ২০১২-১৩ অর্থবছরে। ওই সময়ের নদীর গতি প্রকৃতির সঙ্গে বর্তমানের কোনো মিল নেই। কাজ শুরুর সময় এসব এলাকায় ভাঙনের কোনো লক্ষণ ছিলো না। নদীর স্রোত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে-যার কারণে নতুন নতুন এলাকায় ভাঙন বাড়ছে।
তিনি বলেন, কাজ চলা অবস্থায় ভাঙন দেখেই দুটি পোল্ডারের প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার এলাকায় নদী শাসন করা হয়েছে। নতুন করে আরও ৭ কিলোমিটার এলাকায় তীর সংরক্ষণের জন্য প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। আপাতত ভাঙন কবলিত এলাকায় বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা চলছে। সার্বিক পরিস্থিতি বোর্ডকে জানানো হচ্ছে।
প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পুর) সৈয়দ হাসান ইমাম। তিনি ঢাকা পানি ভবনে বসেন। তার বক্তব্য নিতে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।
খুলনা গেজেট/ টি আই