পূর্ব ও পশ্চিম সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে চলছে পরিবেশ বিধ্বংসী বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের প্রভাবে হুমকিতে মৎস্য সম্পদ। এতে বনের গহীনে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও মাছের পোনা প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে। আর জেলে নামক এক শ্রেণীর দূর্বৃত্তদের এ কাজে সহযোগীতা করছেন বনবিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী। ফলে প্রজনন মৌসুমে সুন্দরবনে মাছ ধরা পাশ পারমিট বন্দ রাখা শুধু কাগজ কলমে সীমাবদ্ধ থাকছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সূত্রে জানা গেছে, সুন্দবনের ৩১ শতাংশ জায়গা জুড়ে রয়েছে জলাভূমি। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে মৎস্য সম্পদ। জালের মত ছড়িয়ে রয়েছে ৪৫০ নদ-নদী। আর এই নদ-নদীতে রয়েছে ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ। এর মধ্যে ২৬ প্রজাতির চিংড়ি, ১৩ প্রজাতির কাঁকড়াসহ অসংখ্য জলজ প্রানী। সরকার প্রতি বৎসর এই মৎস্য সম্পদ থেকে বিপুল পরিমান রাজস্ব আয় করে থাকেন। বর্তমান সুন্দরবনে চলছে মাছের প্রধান প্রজনন মৌসুম। এ জন্য জুন, জুলাই ও আগস্ট এই তিন মাস বনে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা এবং জেলেদের পাশ পারমিট বন্দ রয়েছে। কিন্তু কিছু জেলে নামক দূর্বৃত্তরা কম পরিশ্রমে অধিক মুনাফার আশায় অবৈধ ভাবে সুন্দরবনে প্রবেশ করছেন। আর বনের অভ্যন্তরে প্রতিটি খালে ও নদীতে পরিবেশ বিধ্বংসী বিষ প্রয়োগে করছেন মাছ শিকার। এমনকি মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত নিষিদ্ধ খালেও। আর তাদের এ কাজে প্রতিরোধ না করে আর্থিক চুক্তিতে সহযোগীতা করছেন বনবিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী। আর বন সংলগ্ন এলাকার ওই দূর্বৃত্তদের সঙ্গে কথিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীর গভীর সখ্যতা এবং সহায়তার ফলে মাছের প্রজনন মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে।
জানা গেছে, মধ্য ভাটার সময় খালের গোড়ায় জাল পেতে খালের আগায় বিষ দেওয়া হয়। কিছুক্ষনের মধ্যে মাছগুলো ছটফট করতে করতে দূর্বল হয়ে ভাসতে ভাসতে জালে এসে আটকা পড়ে। এ কাজে সাধারণত ভারতীয় অবৈধ রিপকট, ক্যারাটে, হিলডন, ওস্তাদ ও বিষ পাউডারসহ বিভিন্ন বিষ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এতে একদিকে যেমন বনের গহীনে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও মাছের পোনা ধ্বংস হচ্ছে অন্যদিকে বিষ মিশ্রিত পানি পান করে বাঘ, হরিণসহ বনের নানা বন্য প্রানীও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। আবার ওই বিষ মিশ্রিত মাছ খেয়ে জনসাধারণ পেটের পীড়াসহ নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মাঝে মধ্যে লোক দেখানো অভিযানে দুই একজন দূর্বৃত্ত বিষসহ হাতে নাতে আটক হলেও কখনো নেমে নেই এ কাজ। আর এতে মহা বিপাকে পড়েছেন বৈধ ভাবে মাছ শিকার করে এমন সব জেলেরা। আয় না থাকায় এ সব জেলেরা পরিবার পরিজন নিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বনের অন্যান্য স্থানের ন্যায় পূর্ব বনবিভাগের হাড়বাড়িয়া টহল ফাঁড়ির ফরেষ্টগার্ড (এফজি) ইকতিয়ার উদ্দিন মিন্টু যার ফরেষ্ট নম্বর ২৫ ও চোরাপুটিয়া টহল ফাঁড়ির নৌকা চালক (বিএম) নাসির উদ্দিন যার ফরেষ্টগার্ড নম্বর ৮১ সহযোগিতায় ওই টহল ফাঁড়ির আওতায় বিভিন্ন নদী খালে স্থানীয় জয়মনি, সুন্দর তোলা ও চিলা এলাকার কিছু অসাধু জেলে একই ভাবে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করে আসছেন। প্রতি অমাবস্যা ও পূর্নিমার গোনে টোনাজালের প্রতি নৌকা ১৫ হাজার, বেবদিজালের নৌকা ১০ হাজার, হরিণ শিকারের নৌকা ৯ হাজার, বশির নৌকা ২ হাজার ও কাঁকড়ার নৌকা ১ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন মিন্টু ও নাসির উদ্দিন।
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ইকতিয়ার উদ্দিন মিন্টু ও নাসির উদ্দিন। সুবিধা না পাওয়া ব্যক্তিরা এমন কথা বলছে বলে তাঁরা জানান।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোজাম্মেল হক নিজামী বলেন, বিষ মিশ্রিত মাছ খেলে সাধারণত মানুষের কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকলে এক সময়ে কিডনি ও লিভার নষ্ট হয়ে মারা যায়। বিষ মিশ্রিত পানি খেলে বিভিন্ন প্রাণীরও একই সমস্যা হতে পারে।
এবিষয়ে খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল জানান, যে খালে বা জলাশয় বিষ প্রয়োগ করা হয় কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে সেখানে কোন মাছ প্রবেশ করতে পারে না। ফলে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন কার্যক্রম চরম ভাবে ব্যাহত হয়।
এব্যাপারে সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এনামূল হক বলেন, এ পর্যন্ত অনেক অনেক জেলেকে বিষ নৌকাসহ আটক করে মামলা দিয়ে কোর্টে চালান দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যারা দোষ স্বীকার করেছে তাদের অর্থদন্ড দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া যে সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পেলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।