কোন রোগীর কিডনি বিকল হলে ডায়ালাইসিস করতে হয়, সেটা অ্যাকিউট রেনাল ফেইলিওর এবং ক্রনিক রেনাল ইনজুরি হতে পারে। ডায়ালাইসিস একটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা ব্যবস্থা। সবার জন্য এর ব্যয় বহন করা খুবই কঠিন। ফলে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ (সামেক) হাসপাতালের ৬টি ডায়ালাইসিস মেশিন দীর্ঘ ৮ মাস ধরে বিকল থাকায় চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন জেলার কিডনি রোগীরা।
সামেক হাসপাতালে সিরিয়াল না পেয়ে দূর-দূরন্ত থেকে আসা অনেক কিডিনি রোগী ডায়ালাইসিস করতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন। আবার বাধ্য হয়ে অনেক রোগীকে বেশি টাকা খরচ করে বাইরের হাসপাতাল বা ক্লিনিক থেকে ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছে। এতে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে সাধারণ কিডনি রোগীদের। তাছাড়া এখানে নেই কোনো কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
এমতাবস্থায় সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পক্ষ থেকে ৫৫টি নতুন কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিন ও কিডনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করা হলেও এখনো পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি বলে জানান হাসপাতালের পরিচালক।
প্রসঙ্গত, উন্নত চিকিৎসা সেবার জন্য ২০১১ সালে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় প্রতিষ্ঠিত হয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ৫০০ শয্যার এ হাসপাতালে ২০১৩ সালে দুটি ডায়ালাইসিস মেশিন দিয়ে প্রথমে কিডনি রোগীদের সেবা দেয়া শুরু হয়। ২০১৫ সালে স্থাপন করা হয় আরো কিছু ডায়ালাইসিস মেশিন। বর্তমানে সেখানে ১৬টি মেশিন থাকলেও সময় মত প্রয়োজনীয় সার্ভিসিং না করায় নষ্ট হয়ে গেছে ছয়টি। যেগুলো সচল রয়েছে তাতে সিরিয়াল পেতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন কিডনি রোগীরা। শুধু সাতক্ষীরা নয়, খুলনা, যশোরসহ আশপাশের জেলা থেকেও কিডনি রোগী ডায়ালাইসিস করতে আসেন এখানে। তবে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কিডনি বিশেষজ্ঞ উকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়নি। এতে প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছেন না কিডনি রোগীরা।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, মাত্র ৪০০ টাকা দিয়ে কিডনি ডায়ালাইসিস করা হয় সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। যেখানে বেসরকারি হাসপাতালে কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়। তবে সাত-আট মাস ধরে হাসপাতালের ছয়টি ডায়ালাইসিস মেশিন নষ্ট থাকায় দূর-দূরান্ত থেকে আসা কিডনি রোগী সিরিয়াল না পেয়ে ডায়ালাইসিস করতে পারছেন না। ফলে অত্যাবশ্যকীয় এই স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে অনেক রোগীকে। এতে করে মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ছে অনেক কিডনি রোগীদের।
শ্যামনগর উপজেলার নকিপুর গ্রামের সিরাজুল ইসলামের বাবা রফিকল ইসলাম (৬৫) কিডনি রোগে আক্রান্ত। ডায়ালাইসিস করার জন্য বাবাকে সঙ্গে নিয়ে সামেক হাসাপাতালে এসেছেন। তবে এখানে এসে জানতে পারেন অধিকাংশ ডায়ালাইসিস মেশিন নষ্ট। যে কয়টা সচল রয়েছে সেখানে সিরিয়াল পেতে এক থেকে দেড় মাস লাগবে। হতাশ হয়ে বাবাকে নিয়ে চলে যান খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শুধু সিরাজুল ইসলাম নন, প্রতিদিন সামেক থেকে এমন অসংখ্য কিডনি রোগী ফিরে যাচ্ছেন।
রোগীর স্বজনরা মনে করেন, সরকারি খরচে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের জন্য মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালটি চালু হলেও কাঙ্খিত সেবা মিলছে না। ডায়ালাইসিস মেশিন বিকল থাকায় স্বল্প আয়ের রোগীরা পড়েছেন বেশি বিপাকে। দ্রুত এ বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।
এ ব্যাপারে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. কাজী আরিফ আহমেদ বলেন, উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় যেভাবে কিডনি রোগী বাড়ছে, সে তুলনায় চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল। হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এখানে কিডনি বিশেষজ্ঞ কোন চিকিৎসক দেয়া হয়নি। এ কারণে জেলা ও জেলার বাইরে থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা বিড়ম্বনায় পড়েন। হাসপাতালে কিছু রোগী কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা পান। তবে সেটি চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
ডা. কাজী আরিফ আহমেদ আরো বলেন, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরিভাবে কিডনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও পর্যাপ্ত ডায়ালাইসিস মেশিন স্থাপন করা দরকার। অন্য যেকোনো চিকিৎসার তুলনায় ব্যয়বহুল কিডনি রোগের চিকিৎসা। এ রোগে আক্রান্ত স্বল্প আয়ের মানুষ চিকিৎসা খরচ জোগাড় করতে পারেন না ঠিকমতো। সরকারি খরচে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার সব নাগরিকেরই রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. কুদরত-ই-খোদা বলেন, বিগত ২০১৫ সালের দিকে জাপান ও জার্মান থেকে আমদানি করা হয় ১৬টি ডায়ালাইসিস মেশিন। এসব মেশিনের বয়স আট-নয় বছর পেরিয়ে গেছে। তার পরও কখনো কখনো মেরামত করে চালানো হয় কিডনি ডায়ালাইসিসের কাজ। তবে সাত-আট মাস ধরে ছয়টি মেশিন নষ্ট হয়ে আছে। তাছাড়া একজন কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও দরকার। ৫৫টি নতুন ডায়ালাইসিস মেশিন ও কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। যদিও এখনো সেগুলো পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘জেলার ২৩-২৪ লাখ মানুষের কিডনি বা অন্যান্য রোগের উন্নত চিকিৎসার একমাত্র স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো এটি। হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সংকট লেগেই রয়েছে। বিশেষ করে কিডনি রোগের বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক সেই এখানে। ২০১৫ সালের পর থেকে সামেক হাসপাতাল কিডনি ডায়ালাইসিস সুবিধা পাচ্ছেন সাতক্ষীরা সহ পার্শ্ববর্তী জেলার রোগীরা। ফলে দীর্ঘ ৭-৮ মাস ধরে ছয়টি ডায়ালাইসিস মেশিন নষ্ট থাকায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।কিডনি আক্রান্ত রোগীরা। তিনি দ্রুত এ সমস্যার সমাধানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
খুলনা গেজেট/এনএম