খুলনা, বাংলাদেশ | ২১ আশ্বিন, ১৪৩১ | ৬ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  ফের জামিন নামঞ্জুর সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের
  শেরপুর ও ময়মনসিংহে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, এ পর্যন্ত নিহত ৭

সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণে বাঘ বিধবা নারীদের নিয়ে সামাজিক সংলাপ

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণে সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগরের বাঘ বিধবা নারীদের নিয়ে এক সামাজিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ এনভায়রমেন্ট অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট সোসাইটি (বেডস্) এর সহযোগিতায় ও ইকো মেন প্রকল্পের আওতায় পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথনেট ফর গ্লোবাল ক্লাইমেট জাস্টিসের উদ্যোগে শনিবার (৫ অক্টোবর) শ্যামনগর উপজেলার কলবাড়ীর সিডিও অফিসে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।

ইকো মেন প্রকল্পের জেলা সমন্বয়ক হাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় সংলাপে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, বাঘ-বিধবাদের নিয়ে কাজ করা সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ পিযুষ বাউলিয়া পিন্টু, জলবাযু কর্মী শামিম হোসেন, সংবাদকর্মী জুবায়ের মাহমুদ, ইয়ুথনেট ফর গ্লোবাল ক্লাইমেট জাস্টিসের সাতক্ষীরা জেলা সমন্বয়ক ইমাম হোসেন ও এনজিওকর্মী রুবিনা পারভীন প্রমুখ।

জীবন-জীবিকার তাগিদে সুন্দরবনে গিয়ে বাঘের আক্রমণে স্বামী হারা শ্যামনগর উপজেলার ২০ জন ‘বাঘ-বিধবা’ নারী এবং স্থানীয় সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ ও যুবরা এই সংলাপে অংশ নেন।

সংলাপে বাঘ-বিধবা সোনামনি বলেন, ১৯৯৯ সালে আমার স্বামীকে বাথে ধরে নিয়ে যায়। এ কারণে কোলের একমাস বাচ্চাসহ আমার শ্বাশুড়ি আমাকে তাড়িয়ে দেন। তখন আমাকে বাচ্চা নিয়ে পথে পথে ঘুরতে হয়েছে। পরে আমার দেবর আমাকে বিয়ে করে। ২০০৩ সালে তাকেও বাঘে ধরে। এরপর থেকেই আমাকে ‘অপায়া’, ‘অলক্ষ্মী’, স্বামীখেকো’ অপবাদ মাথায় নিয়ে থাকতে হয়। কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলেও খেতে দেয় সবার শেষে।

সোনামনি আরও বলেন, সকালে উঠে যেন আগে আমার মুখ দেখতে না হয়, তাই শাশুড়ি আমাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতেন। এ জীবন তো মৃত্যুর মতোই। স্বামী গেল বাঘের পেটে, আমাকেও মেরে রেখে গেল। আজ আমার দেখার কেউ নেই।

‘বাঘ-বিধবা’ বুলি দাশী বলেন, আমার স্বামী অরুণ মন্ডল ২০০২ সালে সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হন। এর জন্য আমাকেই দায়ী করে নির্যাতন করতে থাকেন শাশুড়ি। একপর্যায়ে বাড়ি থেকেই তাড়িয়ে দেন। আমার বাবা মারা গেছে অনেক আগেই। তাই ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে ওঠি। কিন্তু ভাইও তো গরিব, তাই নদীতে রেণুপোনা ও কাঁকড়া ধরে সংসার চালাতে শুরু করি। এভাবেই ছেলে-মেয়েদের বড় করেছি।

বুলি দাশী বলেন, আমার মতো এমন অনেক মেয়ে আছে, যাদের স্বামী বাঘের হাতে মারা যাওয়ার পর তাদের অপয়া বলে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমার স্বামীর ছোট ভাইও বাঘের আক্রমণে মারা যায়। তার বউ দিপালীকেও বাপের বাড়ি তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

সংলাপে অতিথিরা বলেন, কুসংস্কারেরই একটি প্রতিচ্ছবি ‘বাঘ-বিধবা’ অপবাদ। বিয়ে-জীবন-মৃত্যু সৃষ্টিকর্তার হাতে। অথচ এ জন্য দায়ী করা হয় অসহায়-অবলা নিষ্পাপ স্ত্রীকে। সুন্দরবনে প্রবেশের আগে বনজীবীরা বন বিবির পূজা করে। এর বাইরেও তাদের মধ্যে আরো অনেক কুসংস্কারই আছে। যেমন কারো স্বামী সুন্দরবনে গেলে সেই নারী অন্য পুরুষের সাথে কথা বলতে পারেন না, চুল আঁচড়াতে পারেন না, শরীরে তেলও মাখতে পারেন না। বিভিন্ন ধরনের সচেতনতা কার্যক্রমে এসব কুসংস্কার অনেকটা কমেছে। তবে এখনো অনেক পরিবার এসব কুসংস্কার মেনে চলে। এই কুসংস্কার থেকে তাদের বের করে আনার দাবি জানান বক্তারা।

সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ পিযুষ বাউলিয়া পিন্টু বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় প্রায় এক হাজার ১৬৩ ‘বাঘ-বিধবা’ নারী রয়েছেন। তবে সরকারি হিসাবে সুন্দরবনে বাঘের হামলায় প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত বাঘ-বিধবা মাত্র পাঁচজন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, মধু সংগ্রহ বা মাছ ধরার মতো কাজে যারা সুন্দরবনে যান, তাদের অনেকে সরকারি নিয়ম অনুসরণ করেন না। অনেকেই অন্যের পাস ব্যবহার করে প্রবেশ করেন সুন্দরবনে। তারা সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মারা গেলেও তাদের নাম সরকারি হিসাবে ওঠে না।

পিযুষ বাউলিয়া পিন্টু আরো বলেন, বিগত সময়ে বাঘের হামলায় নিহত হলে পরিবারকে এক লাখ টাকা ও আহত হলে চিকিৎসার জন্য ৫০হাজার টাকা দেয়ার সরকারি নিয়ম ছিল। কিন্তু অনেকেই অন্যের নামের পাস নিয়ে বনে যান। তাদের জন্য সরকারি কোনো সুবিধা নেই। তিনি উপকূলের সব বাঘ বিধাব নারীদেরকে সরকারি সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনার দাবি জানান।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!