কালো টাকার পাহাড় গড়েছেন যশোরের সাবেক সাব রেজিস্ট্রার শাহজাহান আলী। বর্তমানে খুলনা শহরে তার তিনটি বাড়ি ও কয়রায় একটি ইটভাটাসহ পাহাড়সম সম্পদ রয়েছে। চড়েন চল্লিশ লাখ টাকা মূল্যের অত্যাধুনিক গাড়িতে। আয়, ব্যয় ও সম্পদের সাথে সামঞ্জস্য না থাকায় তার বিরুদ্ধে দুদকে মামলা হয়েছে। সোয়া কোটি টাকার অধিক জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের হিসাব দিতে না পারায় তাঁর বিরুদ্ধে এ মামলা করেছেন দুদকের সহকারী পরিচালক মোশারফ হোসেন।
সূত্র জানায়, যশোরে সর্বশেষ কর্মরত সাব রেজিস্ট্রার শাহজাহান আলী চাকরি জীবনের শুরু থেকেই ব্যাপকভাবে দুর্নীতিতে জড়িয়ে ছিলেন। সরকারি অফিসে অনিয়মের মাধ্যমে আদায়কৃত টাকায় তিনি সম্পদের পাহাড় গড়তে থাকেন। টাকা ছাড়া তিনি কোন কাজ করতেন না বলে অফিসে তার বদনাম ছিল। যদিও চাকরি জীবনে এ কাজে অফিসে তার নিজস্ব কয়েকজন চ্যালা চামুন্ডা থাকতো। তাদের মাধ্যমেই তিনি সকল অবৈধ কাজের টাকা আদায় করতেন বলে যশোর নেজিস্ট্রি অফিস সূত্র জানিয়েছে।
বর্তমানে আলোচিত এ সাব রেজিস্ট্রার চাকরি জীবন শেষ করে অবসরে আছেন। তিনি খুলনার কয়রা উপজেলার জায়গীরমহল গ্রামের মৃত আছতুল্যাহ গাইনের ছেলে। বর্তমানে তিনি বসবাস করেন খুলনা সিটি কর্পোরেশনের শিপইয়ার্ড এলাকার আলতাফ হোসেন রোডের ডাক্তার বাড়ির গলির ২৯/১৮ নম্বর বাড়িতে। তিনি ১৯৭৮ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর ১৯৮০ সালে এইচএসসি, ১৯৮৪ সালে বি কম ও ১৯৯০ সালে এলএলবি পাস করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলে রাহাতুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি সম্মানসহ এমএসসি পাস করে বর্তমানে স্ত্রী নিয়ে আমেরিকায় বসাবস করছেন। এছাড়া মেয়ে ইসরাত জাহান ঐশিকে এইচএসসি পাস করার পর বিয়ে দিয়েছেন।
সাব রেজিস্ট্রি অফিসে যোগদানের পর থেকে তার পেশাগত জীবন শুরু হয়। চাকরির শুরু থেকেই তিনি যেসব জেলায় কাজ করেছেন সবখানে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছেন। এ পর্যায়ে যশোরে সাব রেজিস্ট্রার পদে কর্মরত অবস্থায় তার ওপেন সিক্রেট দুর্নীতি ও অগাধ সম্পদের বিষয়টি দুদকের নজরে আসে। এরপর দুদক সমন্বিত যশোর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোশারফ হোসেনসহ একটি টিম তার সম্পদের বিষয়ে তদন্ত শুরু করে। এসময়ে তারা শাহজাহান আলীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন করে নিজ দখলে রাখার অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পান। এরপর তাকে ২০২০ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে তার সম্পদের বিবরণী চেয়ে নোটিশ জারি করা হয়। তিনি সম্পদের বিবরণী ফরম পূরণ করে ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর দুদকে দাখিল করেন।
সম্পদ বিবরণীতে শাহজাহান আলী তার নিজ নামে ৮৯ হাজার ৪৫৬ টাকার জমি ও দুটি ভবন নির্মাণে ৫ লাখ ও এক কোটি ৮ লাখ টাকা দেখিয়েছেন। যার মোট পরিমাণ এক কোটি ১৩ লাখ ৮৯ হাজার ৪৫৬ টাকা স্থাবর ও ব্যাংকে দুই লাখ ২৮ হাজার ৫৭৮ টাকা, সঞ্চয়পত্র দুই লাখ টাকা, নগদ ২৫ হাজার ৬৫৩ টাকা, বৈদেশিক মুদ্রা দুই লাখ ৮৯ হাজার ৪৯১ টাকাসহ মোট অস্থাবর সাত লাখ ৪৩ হাজার ৭২ টাকা। এ হিসেবে তার টাকাসহ স্থাবর ও অস্থাবর মোট সম্পদের পরিমাণ এক কোটি ২১ লাখ ৩৩ হাজার ১৭৮ টাকা বলে তিনি ঘোষণা দেন ও দুদকে কাগজপত্র দাখিল করেন। দুদক কর্মকর্তারা তার সম্পদের বিবরণী যাচাইকালে নানা অসঙ্গতি দেখতে পান। শাহজাহান আলীর নিজ নামে ২৯/১৮ ডাক্তার আলতাফ হোসেন লেন, শিপইয়ার্ড, খুলনার টুটপাড়া মৌজায় ০.০৪৯৫ একর জমির উপর দ্বিতীয়তলা ভবন, বানিয়াখামার মৌজায় নিরালা আবাসিক এলাকায় প্লট নং-ই, এক্স-৩, রোড নং-২৮ এর ০.০৪৯৫ একর জমির উপর ছয়তলা বিশিষ্ট ভবন পাওয়া যায়। এসব ভবন নির্মাণ নিরূপনের জন্য খুলনা গণপূর্ত বিভাগ-১ এর উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী মো: আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে গঠিত নিরপেক্ষ প্রকৌশলী টিম পরিমাপ করেন। এ টিমের দাখিলকৃত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দুদক দেখতে পায় ভবন দুটির নির্মাণ ব্যয় হয়েছে দুই কোটি ৬১ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩১ টাকা ও ৪০ লাখ ৫২ হাজার ৯৩০ টাকা। ব্যক্তিগতভাবে নির্মাণ করার কারণে ১৯ ও ২০ ভাগ ব্যয় বাদ দিয়ে ভবন দুটির মোট নির্মাণ খরচ ধরা হয়েছে দুই কোটি ১১ লাখ ৭০ হাজার ৪২৮ টাকা ও ৩২ লাখ ৪২ হাজার ৩৪৪ টাকা। যার মোট পরিমাণ দুই কোটি ৪৪ লাখ ১২ হাজার ৭৭২ টাকা। এছাড়া হিসাব বিবরণীতে দাখিলকৃত জমির দাম ছিল ৮৯ হাজার ৪৫৬ টাকা। এ হিসেবে তার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দুই কোটি ৪৫ লাখ ২ হাজার ২২৮ টাকা। অথচ তিনি দুদকে তার মোট সম্পদের হিসাব দাখিল করেছেন এক কোটি ১৩ লাখ ৮৯ হাজার ৪৫৬ টাকা। এ হিসেবে তিনি এক কোটি ৩১ লাখ ১২ হাজার ৭৭২ টাকার স্থাবর সম্পদ থাকার তথ্য দুদকে গোপন করেছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন ওই টাকার তথ্য গোপন করা ও মিথ্যা তথ্য প্রদান করায় এক কোটি ২৭ লাখ ৫ হাজার ১৭৭ টাকার জ্ঞাত আয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ দখলে রাখার অপরাধে মামলা করার আবেদন জানান দুদকের সহকারী পরিচালক মোশারফ হোসেন। এরই প্রেক্ষিতে অনুমোদন সাপেক্ষে গত বছরের ৫ ডিসেম্বর খুলনা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নং-৯। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৬ (২) ও ২৭ (১) ধারায় সহকারী পরিচালক মোশারফ হোসেন বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্তকালে শাহজাহান আলীর দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট সহযোগী ব্যক্তিদেরও আইনের আওতায় আনা হবে বলে মামলা উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে, অগাধ সম্পদের মালিক শাহজাহান আলীর গ্রামে তার নামে বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের খোঁজ মিলেছে। খুলনার মদিনাবাদ ও ফতেয়াবাদ ছাড়াও কয়রা উপজেলার জায়গীরমহল গ্রামের বিপুল পরিমাণ জমিতে তার একটি ইটভাটা রয়েছে। এছাড়া, রয়েছে গ্রামে বিঘার পর বিঘা জমি ও আলিশান বাড়ি। বর্তমানে তিনি নিরালা আবাসিক এলাকার ছয়তলার বাড়ির তৃতীয় তলায় বসবাস করেন ও নীচতলায় উই ওপেন দ্যা ওয়ার্ল্ড নামে একটি কনসালটেন্সি ফার্ম খুলে ব্যবসা করছেন। যার মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠানো থেকে শুরু নানা প্রতারণামূলক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে সূত্রটি জানিয়েছে। এছাড়া তিনি রাজকীয় হালে খুলনা ও কয়রা উপজেলায় চলাফেরা করেন। চড়েন চল্লিশ লাখ টাকা মূল্যের অত্যাধুনিক গাড়িতে। একজন অবসরপ্রাপ্ত সাব রেজিস্ট্রারের এ জাতীয় ঠাঁট-বাট দেখে এলাকাবাসীর মধ্যেও রয়েছে নানা প্রশ্ন।
এ ব্যাপারে শাহজাহান আলীর সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতে রাজি হননি।
মামলা বাদী দুদকের সহকারী পরিচালক মোশারফ হোসেন বলেন, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে এ মুহুর্তে মামলা সম্পর্কে কিছুই বলা যাবে না। তবে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে তিনি বিস্তারিত তথ্য দিতে পারবেন বলে জানান।
বিষয়টি নিয়ে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় যশোরের উপ পরিচালক আল আমিন বলেন, যশোরের সাবেক সাব রেজিস্ট্রার শাহজাহান আলী বিরুদ্ধে সম্পদের তথ্য গোপন করা ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা দয়ের করা হয়েছে। বিষয়টি দুদকের তদন্তাধীন রয়েছে বলে তিনি জানান।
খুলনা গেজেট/কেডি