করোনা মহামারির মধ্যে গত দেড় বছরে সাতক্ষীরা জেলায় বাল্যবিয়ে হয়েছে সহস্রাধিক। করোনাকালে আর্থিক অনিশ্চয়তা ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় কারণেই বাল্যবিয়ের ঘটনা বেশি ঘটেছে। বাল্যবিয়ের শিকার অধিকাংশই অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির ছাত্রী। তবে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার প্রাথমিকভাবে ৫০০-৬০০ বাল্য বিয়ের কথা স্বীকার করলেও সঠিক কোন তথ্য দিতে পারেননি।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, স্কুল খোলার পর ছাত্রীদের খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু হয়। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। তবে এ বিষয়ে বিদ্যালয় গুলোতে তথ্য চাওয়া হলেও তেমন কোন তথ্য প্রতিষ্ঠান থেকে এখনো সরবরাহ করা হয়নি। বর্তমানে ছাত্রীদের হাজিরা বেড়েছে বলেও তিনি জানান।
গত বছরের মার্চ থেকে টানা দেড় বছর বন্ধ থাকার পর ১২ সেপ্টেম্বর সারা দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। খোলার পরও অনেক ছাত্রী স্কুলে নিয়মিত আসছে না বলে নজরে আসে শিক্ষকদের। এরও আগে অনেক ছাত্রী স্কুলে নিয়মিত তাদওে অ্যাসাইনমেন্টও জমা দিচ্ছিল না।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল খোলার পর দুই সপ্তাহের মধ্যে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার নলতা গার্লস হাইস্কুলের ৫৪ জন ছাত্রী স্কুলে আসেনি। এসব ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তারা বিদ্যালয়ে আসছে না বলে জানান প্রধান শিক্ষক। একইভাবে শ্যামনগরের নওয়াবেঁকি সফিরুন্নেছা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ৮২ জন ছাত্রী স্কুলে আসছে না। প্রধান শিক্ষকের দাবি, এদের সবার না হলেও ৯০ শতাংশ ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে।
একটি বে-সরকারি সংস্থার সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাল্যবিবাহের উপর একটি জরিপ কার্য সম্পন্ন করছে। তাদের দেওয়া তথ্য থেকে দেখা যায়, শুধু সদর উপজেলার আলিপুর ইউনিয়নের তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাল্যবিয়ে হয়েছে ৬৯জন ছাত্রীর। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো, আলিপুর ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। যেখানে বাল্য বিয়ে হয়েছে ১২ জন ছাত্রীর, আলিপুর আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ে বাল্যবিয়ে হয়েছে ৪৭ জন ছাত্রীর এবং মাহমুদপুর গালর্স কলেজিয়েট স্কুলে বাল্য বিয়ে হয়েছে ১০ জন ছাত্রীর।
আরও একটি বে-সরকারি সংস্থা বাল্যবিয়ের বিষয়ে জেলার ৬ উপজেলায় জরিপ কার্য পরিচালনা করেছেন। তাদের দেওয়া তথ্য ২৬ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ ম শ্রেণির মোট ৫৭৪ জনের বাল্য বিয়ে হয়েছে।
এদিকে, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সাতক্ষীরার উপ-পরিচালক (চ: দা:) একেএম, শফিউল আযম জানান, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেলার ৭টি উপজেলায় বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয়েছে ১১১টি। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ৩১ টি, তালায় ৪০ টি, কলারোয়ায় ১৪ টি, কালিগঞ্জে ৮ টি, আশাশুনি উপজেলার ৩ টি, দেবহাটায় ৩ টি এবং শ্যামনগর উপজেলায় ১২ টি বাল্য বিয়ে বন্ধ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমার বাল্য বিয়ের খবর পেয়ে ঘটনা স্থলে গিয়ে তাৎক্ষণিক বিয়ে বন্ধ করে আসি। কিন্তু পরবর্তীতে অন্য কোথাও গিয়ে তারা বিয়ে করে নিচ্ছে। কোনভাবেই বাল্য বিয়ে বন্ধ করা যাচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাল্য বিয়ে বন্ধে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন সব মিলিয়ে মোট ৮৬ টি কমিটি রয়েছে। জেলা পর্যায়ে কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক। উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা বাল্যবিয়ে নিরোধ কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার। ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন বাল্যবিয়ে নিরোধ কমিটির সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান। তবে পৌরসভায় কোন কমিটি নেই। এসব কমিটির অধিকাংশর অবস্থাই নড়বড়ে। নেই তেমন কোন ভূমিকা।
আরও জানা যায়, প্রতিটি ইউনিয়নে বাল্যবিয়ে নিরোধ কমিটি রয়েছে। যে কমিটির সদস্য সংখ্যা ২০ জন। এছাড়া উপজেলা ও জেলা কমিটি রয়েছে। এসব মিলিয়ে জেলায় বাল্যবিয়ে নিরোধ কমিটিতে প্রায় দুই হাজার সদস্য রয়েছে। তবে ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন বাল্যবিয়ে নিরোধ কমিটিতে ২০ জন সদস্য থাকলেও সে কমিটিকে তেমন ভূমিকা রাখতে দেখা যায় না। বরং পরোক্ষভাবে বাল্যবিয়েতে সহায়তা করতে দেখা যায়।
এছাড়া উপজেলা বাল্যবিয়ে নিরোধ কমিটির নিয়োমিত সভা হওয়ার কথা থাকলেও অন্যান্য সভার সাথে বাল্যবিয়ে নিরোধ কমিটির সভা দেখিয়ে হাজিরায় স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়। তবে, তালা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাকে মাঠ পর্যায়ে কঠোর ভূমিকা রাখতে দেখা যাচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, করোনাকালে বাল্য বিয়ের সঠিক তথ্য নেই। তবে বিদ্যালয় খোলার পর কয়েকটি বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে ছাত্রী হাজিরা কম পাওয়া যায়। সে সময় প্রাথমিকভাবে ৫০০-৬০০ ছাত্রীর বাল্য বিয়ে হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ছাত্রী হাজিরা আগের তুলনায় বেড়েছে। তাছাড়া সকল শিক্ষার্থীর জন্য ইউনিক আইডি খোলার কাজ চলমান রয়েছে। আইডি খোলা হলে তখন বাল্য বিয়ে আরও কমবে।
খুলনা গেজেট/এএ