প্রতি বছরের মতো এ বছরও ১ ডিসেম্বর উদযাপিত হলো বিশ্ব এইডস দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো “Global Solidarity, Shared Responsibility” অর্থাৎ “সারা বিশ্বের ঐক্য, এইডস প্রতিরোধে সবাই নিব দায়িত্ব।” এইডস হলো এইচআইভি বা হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট এমন এক প্রাণ সংহারক সংক্রামক রোগ, যা মানুষের শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে। এইডস (AIDS) এর পূর্ণরূপ হল Acquired Immune Deficiency Syndrome। যেহেতু এইডস শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ক্রমান্বয়ে ধ্বংস করে, তাই এইডসে আক্রান্ত রোগী খুব সহজেই যে কোন সংক্রামক রোগ, যেমন- নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, ডায়রিয়া ইত্যাদিতে আক্রান্ত হতে পারেন, যা শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু ঘটাতে পারে।
ভয়ের বিষয় এই যে, এইডস এর কোন প্রতিষেধক বা ভালো কার্যকর ওষুধ এখনও আবিষ্কার করা সম্ভব হয় নি। মানবদেহে এইচআইভি ভাইরাস প্রবেশ করার সাথে সাথেই কিন্তু শরীরে এইডস এর লক্ষণ দেখা যায় না। এইচআইভি ভাইরাস শরীরে প্রবেশের কতদিন পর একজন ব্যক্তির মধ্যে এইডস এর লক্ষণ দেখা যাবে তা নির্ভর করে ঐ ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার উপর। এইচআইভি সংক্রমণের শুরু থেকে এইডস হওয়া পর্যন্ত সময়ের ব্যাপ্তি সাধারণত ৬ মাস থেকে বেশ কয়েক বৎসর এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ বৎসর পর্যন্তও হতে পারে। এইসময়কালে এইচআইভি সংক্রমিত একজন ব্যক্তি নিজের অজান্তেই অন্য একজন সুস্থ ব্যক্তির দেহে ছড়িয়ে দিতে পারেন এই প্রাণঘাতী ভাইরাস।
লক্ষণসমূহ : এইডস এর সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষণ নেই। এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তি অন্য কোন রোগে আক্রান্ত হলে সেই রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। এইডসে আক্রান্ত হওয়ার একেবারে প্রথম দিকের লক্ষণ হতে পারে মৃদু জ্বর, যা প্রায় ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে এবং এর সাথে থাকতে পারে কিছু সাধারণ মৃদু উপসর্গ যেমন মাথা ব্যথা, ক্লান্তি, লসিকা গ্রন্থির স্ফীতি এবং গলা ব্যথা। এগুলো একিউট রেট্রোভাইরাল সিন্ড্রোম বা প্রাইমারি এইচআইভি ইনফেকশনকে নির্দেশ করে।
এছাড়া সমস্ত শরীরে বিশেষত অস্থিসন্ধি এবং মাংসপেশীতে ব্যথা অনুভূত হয় এবং এটির কারণে ক্লান্তি এবং তন্দ্রা ভাবও হতে পারে। এইচআইভি সংক্রমণের প্রথম এবং পরবর্তী লক্ষণ উভয়ই হতে পারে এই ক্লান্তি বোধ। পাশাপাশি এইডসের প্রথম দিকে এবং পরবর্তীতে চামড়ায় ছোটো ছোটো ফুসকুঁড়ি দেখা দিতে পারে। এইডসের প্রাথমিক পর্যায়ে ৩০% থেকে ৬০% লোক স্বল্প মেয়াদী বমি ভাব, বমি কিংবা ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হয়ে থাকে। তবে এ সকল লক্ষণগুলি চিকিৎসাকালীন এন্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপির কারণে কিংবা পরবর্তীতে সংক্রমণের কারণেও দেখা দিতে পারে। সেইসাথে মারাত্মক ডায়রিয়া সংক্রমণের ফলশ্রুতিতে ওজন কমে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দিতে পারে। কোন আক্রান্ত ব্যক্তি যদি ডায়রিয়া বা দুর্বলতা ও ৩০ দিনের বেশী একাধারে জ্বরে ভুগে থাকেন এবং ঐ সময়ে তাঁর শরীরের ওজন ১০% হ্রাস পায়, তবে ঐ ব্যক্তি Wasting Syndrome এ আক্রান্ত বলে ধরে নেওয়া যায়। কয়েক সপ্তাহ ধরে যদি শুষ্ক কাশি বা নিউমোনিয়াও হতে পারে এইডসের লক্ষণ।
এইডসের ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন ধরণের Opportunistic সংক্রমণের সূত্রপাত হয়, যেমন- টক্সোপ্লাসমোসিস (একটি পরজীবীঘটিত সংক্রমণ যা মস্তিস্ক কে আক্রান্ত করে), সাইটোমেগালোভাইরাস সংক্রমণ, Candida নামক ছত্রাক জনিত সংক্রমণ প্রভৃতি। রাত্রি কালীন ঘাম, নখের বিবিধ পরিবর্তন যেমন Clubbing (নখ পুরু হয়ে বেঁকে যাওয়া), নখ ভেঙ্গে যাওয়া বা ছত্রাকের সংক্রমণের কারণে নখের রঙের পরিবর্তন (সমান্তরাল ভাবে বা আড়াআড়ি ভাবে কালো এবং বাদামী দাগ), মুখের ভেতরে ক্ষত, বিভ্রান্তি বা মনোযোগে সমস্যা, স্মৃতিভ্রষ্টতা, পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি, মহিলাদের ক্ষেত্রে অনিয়মিত ঋতুচক্র ইত্যাদিও হতে পারে এইডসের লক্ষণ। তবে কারো মাঝে উপরের এক বা একাধিক লক্ষণ দেখা দিলেই যে তার এইডস হয়েছে- এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে এসব লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই বিলম্ব না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
সংক্রমণ : বাতাস, পানি, খাবার কিংবা স্পর্শের মাধ্যমে এইচআইভি ছড়ায় না। সাধারণত এইচআইভি মানবদেহের কয়েকটি নির্দিষ্ট তরল পদার্থ, যেমন রক্ত, বীর্য ও বুকের দুধের মাধ্যমেই ছড়ায়। এইচআইভি দ্বারা সংক্রমিত ব্যক্তির ব্যবহৃত ইনজেকশনের সিরিঞ্জ বা সূঁচ অন্য সুস্থ ব্যক্তি ব্যবহার করলে, এইচআইভি সংক্রমিত কিংবা এইডসে আক্রান্ত রোগীর রক্ত সুস্থ ব্যক্তির দেহে পরিসঞ্চালন করলে কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তির কোন অঙ্গ অন্য কোন সুস্থ ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করলে অথবা আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে অনিরাপদ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে ঐ ব্যক্তিও এইচআইভি দ্বারা সংক্রমিত হতে পারেন। এইচআইভি তে আক্রান্ত গর্ভবতী মায়ের শিশুরও এইডস এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা মূলত গর্ভধারণের শেষদিকে অথবা প্রসবের সময় বেশি ঘটে থাকে। তবে জিডোভুডিন নামক ওষুধ ব্যবহার করে এই সম্ভাবনা কিছুটা কমানো সম্ভব হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন যৌনরোগ এবং এইচআইভি এর মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। কোনো যৌনরোগে আক্রান্ত কোন ব্যক্তির এইচআইভি দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা একজন সুস্থ মানুষের চেয়ে অনেকগুণ বেশি।
প্রতিরোধ : এইডস কোনো বংশগত রোগ কিংবা সৃষ্টিকর্তার কোনো অভিশাপ নয়। এইচআইভি সংক্রমণ কিভাবে হয়, সে সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এইডস প্রতিরোধ করা যেতে পারে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মাঝে আমাদের দেশ থেকে এইডস নির্মূল করতে এইচআইভি সংক্রমণ প্রতিরোধের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কোন কারণে রক্ত গ্রহণের প্রয়োজন হলে রক্তদাতার রক্তে এইচআইভি আছে কি না সেটা অবশ্যই পরীক্ষা করে নিতে হবে। যৌনসঙ্গী নির্বাচনে সতর্ক হতে হবে এবং শারীরিক সম্পর্কের নিরাপত্তার ব্যপারে নিশ্চিত হতে হবে। অনিরাপদ যৌনমিলনের সময় অবশ্যই কনডম ব্যবহার করতে হবে। যেকোনো যৌনরোগে আক্রান্ত হলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রতিবারই ব্যবহারের পূর্বে ইনজেকশনের নতুন সূঁচ ও সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হবে। এইডস আক্রান্ত মায়ের ক্ষেত্রে সন্তান গ্রহণ, গর্ভকালীন, প্রসব এবং সন্তানকে স্তন্যদানের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
খুলনা গেজেট/কেএম