লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে কাগজের দাম। গত ৬ মাসের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়েছে মুদ্রণশিল্পের অন্যতম এই উপকরণের দাম। গত ৩ সপ্তাহ ধরে অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছে। অগ্রিম টাকা দিয়েও অনেক ছাপাখানার মালিক কাগজ পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় গভীর সংকটে পড়েছে খুলনার মুদ্রণশিল্প।
ছাপাখানা মালিকরা বলছেন, আমদানি নির্ভর কাঁচামাল এবং কাগজের দাম বৃদ্ধিতে কাজ কমে গেছে প্রায় ৬০ ভাগ। এতে ছোট ছোট ছাপাখানাগুলো বন্ধের উপক্রম হয়েছে। দাম বেড়েছে পড়ালেখার কাজে ব্যবহৃত কাগজও। যে লেখার খাতা এক মাস আগে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেই খাতার দাম এখনও ৮০ টাকা। ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে কয়েকজন বড় পাইকারী ব্যবসায়ী ইচ্ছেমত কাগজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে তারা অভিযোগ করেছেন।
মুদ্রণ শিল্প মালিক সমিতির হিসেবে খুলনায় ছোট-বড় মিলিয়ে ছাপাখানা রয়েছে ১০৪টি। প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় ৪ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন। কাজ কমে যাওয়ায় ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীরা চাকরি হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন।
খুলনা প্রেসক্লাবের পাশে বড় মির্জাপুর, বেনী বাবু, ধর্মসভায় সড়কে প্রায় দুই ডজন ছাপাখানা রয়েছে। শনিবার সকালে সড়কগুলো ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ছোট ছাপাখানা বন্ধ। কর্মচারীরা অলস বসে আছেন।
দেশ প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশনের স্বত্ত্বাধিকারী মুন্সি মাহবুবুল আলম সোহাগ বলেন, ‘গত কয়েক মাসে কাগজের দাম বেড়েছে দ্বিগুনেরও বেশি। এখন এমন অবস্থা চলছে সকালে একদাম, বিকালে আরেক দাম। অগ্রিম টাকা দিয়েও কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। লোকসানের আশংকায় সরকারি কাজের দরপত্র জমা দেওয়ার সাহস পাচ্ছি না। খরচ বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি কাজও কমে গেছে। কিন্তু ব্যাংক ঋণ, খরচ তো কমেনি। যে কারণে সব ব্যবসায়ীই কষ্টে আছেন।’
কাকন প্রিন্টিং অ্যান্ড প্রেসের স্বত্তাধিকারী নাসির উদ্দিন জানান, ছোট ছাপাখানার ৬০ ভাগ কাজই স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেনের। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে তারা নতুন বছরের বই, খাতা, শিক্ষা কার্যক্রমসহ প্রয়োজনীয় কাগজ তৈরি করে। কিন্তু কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো হিসাব মেলাতে পারছেন না। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ বন্ধ রেখেছে।
তিনি বলেন, সরকারি দপ্তরগুলোতে যে বরাদ্দ থাকতো গত জুলাইয়ের পর থেকে তাও কমে গেছে। সরকারি দপ্তরগুলোও আগের মতো কাজ করাচ্ছে না। যার কারণে ছাপাখানার সার্বিক কাজ কমে গেছে।
মুদ্রাকরের স্বত্ত্বাধিকারী আরিফ আহমেদ বলেন, অন্যান্য বছর এই সময় দমফেলার ফুসরত থাকতো না। প্রতিদিনই শ্রমিকদের ওভারটাইম কাজ করাতে হতো। কিন্তু এবার কাজ অনেক কম। তিনি বলেন, কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিনই পুরাতন পাটি (গ্রাহকদের) সঙ্গে বাকবিতন্ডতা হচ্ছে।
কয়েকজন ছাপাখানার মালিক কাগজ কেনার হিসাব দেখালেন। দেখা গেছে, ছাপার কাজে বেশি ব্যবহৃত ৫৫ গ্রাম (পুরুত্ব) কাগজের দাম বছরের শুরুতে ছিলো প্রতি রিম ১১২৫ থেকে ১১৫০ টাকা। গত জুন মাসে সেই কাগজের দাম বেড়ে দাড়ায় ১৮০০ টাকা। চলতি সপ্তাহে একই কাগজ কিনতে হচ্ছে ২২৫০ থেকে ২২৮০ টাকা। ৮০ গ্রাম কাগজের দাম গত জুন মাসে ছিলো ২৫৬০ টাকা, গত সপ্তাহে একই কাগজ কিনতে হয়েছে ৩৩০০ টাকায়। ক্যালেন্ডার ছাপানোর আর্টকার্ডের দাম ছিলো ৩৩০০ টাকা। একই কাগজ বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৬৫০০ থেকে ৬৬০০ টাকা। গত জুনে স্টিকার ছিলো প্রতি পিস ১৪ টাকা, গত সপ্তাহে তা বিক্রি হয়েছে সাড়ে ১৭ টাকা।
খুলনা মুদ্রণ শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি ও মধুমতি মুদ্রণালয়ের চেয়ারম্যান এস এম জাকির হোসেন বলেন, করোনার দুই বছর স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় মুদ্রণ শিল্পের দুর্দিন শুরু হয়। এরপর ব্যবসায়ীরা ঘুরাতে দাড়াতে শুরু করেছিলেন। এরই মধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে কাগজের দাম বাড়তে শুরু করে। বর্তমানে যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
তিনি বলেন, বছরের এই সময়টা সবাই ক্যালেন্ডার, ডাইরীসহ বই, খাতা, অন্যান্য প্রকাশনা ছাপানো হয়। কিন্তু দাম বৃদ্ধির কারণে আগে যারা ৫ রিম কাজ করাতেন, তারা ১ রিম করাচ্ছেন। অনেকে কাজই করাচ্ছেন না। কাজ কমে যাওয়ায় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারছি না। মুদ্রণ শিল্পে এমন সংকট অতীতে দেখা যায়নি। অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।