খুলনা, বাংলাদেশ | ১৪ আশ্বিন, ১৪৩১ | ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  দেশে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৭ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৬০
  হেজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ নিহত, নিশ্চিত করেছে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি
  ছাত্র আন্দোলনে ১৫৮১ জন নিহত হয়েছেন : স্বাস্থ্য বিষয়ক উপ কমিটি
ঝরে পড়া এবং শিশুশ্রম বাড়ার শঙ্কা

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে কর্মমুখী হয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা

নিপা মোনালিসা

দশম শ্রেণী পড়ুয়া রাহুল গাজী। বয়স সবে ১৫। করোনায় বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নেই পড়াশোনারও চাপ। তাই সময় কাটাতে করছে গো-খাদ্য বিছালি কাটার কাজ। সাথে রয়েছে আরেক মাদ্রাসা ছাত্র শিবলী সাদিক। দু’জনে মিলে সারাদিন গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিছালি কাটে। যা আয় হয় তা পরিবারের সংসার চালানোর কাজেই ব্যয় করেন তারা।

রাহুল গাজী বলেন, ‘স্কুল বন্ধ, সময় কাটে না, তাই আরেক জনের সাথে বিছালি কাটতি আসি। প্রতিদিন প্রায় দুই তিনশ’ টাকা করে হয়। যা হয় বাড়ি মা’র কাছে দিই। পড়াশুনা করার তেমন সময় পাইনে। মাঝেমধ্যে সকালে বা রাতে একটু বসি।’

আরেক ছাত্র শিবলী সাদিক বলেন, ‘আমি হেফজ পড়ি। সতোরো পারার হাফেজ। করোনায় মাদ্রাসা বন্ধ, সময় কাটে না, বসে ছিলাম তাই চাচাতো ভাই বিছালি কাটার এই গাড়িডা বানায় দেছে। যা আয় হয় আমরা তিনজন ভাগ করে নিই। এই টাকা কিছু বাড়ি দিই আর নিজের পকেট খরচ চালায়।’

শুধু রাহুল বা শিবলী নয়, বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই এখন কর্মজীবি। করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কর্মমুখী হয়ে পড়ছে এসব শিক্ষার্থীরা। পারিবারিক অস্বচ্ছলতা আর সময় কাটাতে অনেকেই বেছে নিচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজও। এদের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে কেউ করছে ক্ষেত বা খামারে দিন মজুরের কাজ, কেউ হোটেলে বা চায়ের দোকানে, কেউ গ্যারেজে বা ওয়ার্কশপে, কেউ ভ্যান বা ইজিবাইক চালাচ্ছে, আবার কেউ করছে ডাব বা সবজির ব্যবসাসহ ছোটখাট বিভিন্ন ব্যবসা। খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলা ঘুরে হরহামেশা এমনটিই চোখে পড়ে।

গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাছে উঠে ডাব পেড়ে শহরে নিয়ে বিক্রি করে সংসারের হাল ধরেছেন পিয়াস। সদ্য এসএসসি পাশ করা পিয়াস সরদার বলেন, ‘কলেজে ভর্তি কবে হব জানিনে। করোনার এই সময় বসে থাইকে কি করব? আব্বার আয় ইনকাম কমে গেছে। তাই আমিও এই ডাবের ব্যবসা শুরু করিচি। গাছে উঠে ডাব পারি। তারপর ডাব নিয়ে শহরে যাইয়ে বেচি। ডাব বেচার টাহা মা’র কাছে দিই। মা সংসার চালায়। কলেজে ভর্তি হলিও এই ব্যবসাটা চালায় যাওয়া লাগবে।’

থুকড়া বাজারে একটি ওয়ার্কশপে কাজ করতে করতে আবুল হোসেন মুন্না বলেন, ‘পড়াশোনা তো এহন করা লাগছে না। বড় ভাইয়ের একার ইনকামে সংসারও চলে না। তাই আমিও এইখানে কাজ শুরু করছি। কলেজ খুললেও এখন আর কলেজে যাওয়া হবে না। শুধু পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দেব।’ মুন্না দৌলতপুর সরকারি বিএল কলেজের ডিগ্রী ২য় বর্ষের ছাত্র।

এদিকে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ এবং আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা আইএলও ‘কোভিড-১৯ ও শিশুশ্রম : সংকটের সময়, পদক্ষেপের সময়’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০ সাল থেকে শিশু শ্রমের সংখ্যা ৯ কোটি ৪০ লাখে কমে আসলেও কোভিড-১৯ এর কারণে সেই অর্জন এখন ঝুঁকির মুখে পড়তে বসেছে। কোভিড-১৯ এর ফলে এ বছরেই ৬ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়তে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, দারিদ্র এক শতাংশ বাড়লে শিশুশ্রম অন্তত দশমিক ৭ শতাংশ বাড়বে।

এ বিষয়ে ডুমুরিয়ার থুকড়া কাছারি বাড়ি আর আর জি টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বীরেশ্বর বৈরাগী বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গ্রামের অনেক ছাত্রছাত্রী কাজের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছে। এতে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক বড় প্রভাব ফেলবে। লেখাপড়ার যে ধারাবাহিকতা এটা থেকে তারা অনেক পেছনে পড়ে যাবে। এদেরকে আবার পড়াশোনার দিকে ফিরিয়ে আনতে অনেক সময় লেগে যাবে। অনেককে হয়তো ফিরিয়ে আনা সম্ভবও হবে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি অভিভাবক এবং ছাত্রদের সাথে যোগাযোগ রাখতে। ফোনের মাধ্যমে নিয়মিত তাদের খোঁজখবর রাখছি।’

শিক্ষাবিদ আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী হয়ে পড়ার বিষয়টি শিক্ষাক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। এদেরকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়বে। আবার যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে তখন অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে। পূর্ব অবস্থায় ফিরে আসাটাও কঠিন হয়ে পড়বে। দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের একটি অংশ কর্মমুখী এবং আরেকটি অংশ এমনিই বিদ্যালয় বিমুখ হয়ে পড়ছে। এতে ঝরে পড়ার সংখ্যাটাও অনেক বেড়ে যাবে। তবে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ না কমলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না পাঠানোর এবং বাসায় বসে যতটুকু সম্ভব পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ তার। এছাড়া আগামীতে উপবৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি বা নতুন কোনও প্রণোদনার মাধ্যমে আবারও এসব শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, করোনা পরিস্থিতিতে গত ১৮ মার্চ থেকে দেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত সাধারণ ছুটির ঘোষণা রয়েছে।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!