নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলায় আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটেছে। গত সপ্তাহে ৩ দিনের ব্যবধানে একজন সাবেক চেয়ারম্যানসহ ৩ জন খুন হয়েছেন। খুনের ঘটনার পর স্হানীয় জনমনে উদ্বেগ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। চাঞ্চল্যকর এসব খুনের ঘটনার পর পুলিশের কোন পদক্ষেপই সাধারণ মানুষজন আশ্বস্ত হতে পারছেন না। ভয়, আতঙ্ক আর চরম নিরাপত্তাহীনতায় কুঁকড়ে গেছেন এ জনপদের সাধারণ মানুষ। অব্যাহত খুনের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা মন্তব্যে সরব হয়ে উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা একটি পৌরসভা ও ১২ টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত। গ্রাম্য কোন্দল আর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ উপজেলা জুড়ে চলে খুন-খারাবি, হামলা-মামলা, ভাংচুর ও লুটপাট। এ উপজেলার এমন কোন গ্রাম নেই-যেখানে কোন্দল নেই। জনপ্রতিনিধি আর মাতুব্বরদের আশ্রয়-প্রশয়ে গ্রাম্য কোন্দলের মীমাংসা হয় না, কোন্দল জিইয়ে থাকে। স্হানীয় পুলিশ প্রশাসনের কোন পদক্ষেপেই থামে না এ অভিশপ্ত গ্রাম্য কোন্দল। ফলে সমগ্র লোহাগড়া জনপদ জুড়ে চলে সংঘাত, সহিংসতা-এ যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। গ্রাম্য কোন্দলের জের ধরে একের পর এক খুনের ঘটনায় লোহাগড়া এখন আতঙ্কিত জনপদে পরিণত হয়েছে। সন্ধ্যার পর খুব প্রয়োজন ছাড়া মানুষজন বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না। অব্যাহত খুনের ঘটনার কারণে চলমান উপজেলা নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণায় ভাটা পড়েছে। ভয়, আতঙ্ক আর চরম নিরাপত্তাহীনতায় আসলেই কুঁকড়ে গেছে লোহাগড়া জনপদ।
তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা গেছে, গত ১০ মে রাত সাড়ে ৭ টার লোহাগড়া বাজার থেকে একটি শালিস বৈঠকে যোগদানের জন্য উপজেলা আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা ও মল্লিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শিকদার মোস্তফা কামাল (৫৯) নিজের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল যোগে কুন্দশী এলাকার ছমীর শিকদারের বাড়ির সামনে সড়কে মোটরসাইকেলটি রেখে বাড়ির ভেতরে যান। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই মোস্তফা মোটরসাইকেলটি আনার জন্য সেখানে গেলে দুর্বৃত্তরা গুলি করে। গুলিবিদ্ধ চেয়ারম্যানকে ঢাকায় নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।
উল্লেখ্য, নিহত শিকদার মোস্তফা কামাল লোহাগড়া উপজেলার মঙ্গলহাটা গ্রামের মৃত আকরাম শিকদারের ছেলে এবং মল্লিকপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি আওয়ামীলীগের সাবেক তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।
চেয়ারম্যান শিকদার মোস্তফা কামাল খুনের ঘটনায় তার ভাই রিজাউল শিকদার বাদী হয়ে সাবেক ইউপি সদস্য আকবর হোসেন লিপনকে প্রধান আসামী করে লোহাগড়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। চেয়ারম্যান খুনের ঘটনার পর পুলিশ ও র্যাব গত বৃহস্পতিবার (১৬ মে) লোহাগড়া, নড়াইল ও চট্টগ্রাম থেকে অভিযান চালিয়ে ভাড়াটিয়া কিলার সাজেদুল মল্লিকসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর আগে একজন আসামী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছে বলে লোহাগড়া থানার ইন্সপেক্টর মেহেদী হাসান জানিয়েছে।
চেয়ারম্যান মোস্তফা খুনের ঘটনার একদিন পর ১১ মে রাতে চর মঙ্গলহাটা গ্রামে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা রিজিয়া বেগম (৭০) নামের একজন বৃদ্ধা মহিলাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে জানালার গ্রীলের সাথে বেঁধে রেখে পালিয়ে যায়। নিহত রিজিয়া বেগম চর মঙ্গলহাটা গ্রামের প্রয়াত শিক্ষক তবিবর রহমানের স্ত্রী এবং যুবলীগ নেতা রবিউল কবীরের মাতা। হত্যার পরের দিন ১২ মে যুবলীগ নেতা রবিউল কবীর বাদী হয়ে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের নামে থানায় মামলা দায়ের করলেও পুলিশ ঘটনার কোন ‘ক্লু’ উদ্ধার করতে পারে নাই।
চেয়ারম্যান ও বৃদ্ধা খুনের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ১২ মে রাত সাড়ে ৮ টার দিকে লোহাগড়া পৌরসভার প্রাণকেন্দ্র ৭ নং ওয়ার্ডের লক্ষ্মীপাশা এলাকার কলা ব্যবসায়ী মো: কাসেম খাঁনের বাড়ির দক্ষিণ পাশে সড়কে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা মো: ফয়সাল মুন্সী (২৫) নামের একজন ভ্যানচালককে ছুরিকাঘাতে খুন করে ভ্যান ও টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। নিহত ফয়সাল লোহাগড়া উপজেলার লোহাগড়া ইউনিয়নের তেতুলিয়া গ্রামের আহম্মদ মুন্সীর ছেলে। এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হলেও খুনের ঘটনার কোন কূলকিনারা করতে পারে নাই পুলিশ।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা লোহাগড়া থানার এসআই অমিত বিশ্বাস জানান, তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে এবং জড়িতদের সনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।
এ বিষয়ে লোহাগড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কাঞ্চন রায় জানান, চেয়ারম্যান, বৃদ্ধা এবং ভ্যানচালক খুনের ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। ইতোমধ্যে চেয়ারম্যান খুনের ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে খুনের ঘটনায় জড়িত ৬ জনকে আটক করা হয়েছে। বৃদ্ধা রিজিয়া বেগম ও ভ্যানচালক ফয়সাল মুন্সী হত্যাকান্ডের বিষয়ে তদন্তকাজ চলছে এবং খুব সহসাই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
খুলনা গেজেট/এনএম