খুলনা, বাংলাদেশ | ৫ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২০ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  বিশ্বকাপ বাছাই : মার্টিনেজের ভলিতে পেরুর বিপক্ষে জয় পেল আর্জেন্টিনা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উপকূলবাসীর দাবি

রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে তুলে আনুক উপকূলের টেকসই বেড়িবাঁধ

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সাতক্ষীরার চারটি আসনে বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের তেমন কোন তৎপরতা না থাকলেও সরকারি দলের সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা ইতিমধ্যে প্রস্তুতি শুরু করেছেন। তারা সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের লিফলেট বিতরণের পাশাপাশি বিভিন্ন পাড়ায় মহল্লায় উঠান বৈঠক করে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তবে নির্বাচন আসলে সাধারণত প্রার্থীদের কাছ থেকে ভোটারদের নগদ সুযোগ সুবিধা নেয়ার উদাহরণই সব থেকে বেশি। কিন্তু সাতক্ষীরার উপকূলে বসবাসকারি সম্পদ হারা ও ফসলহারা ভোটারদের এবারের চাহিদা একটু ভিন্ন রকমের। তাদের চাওয়া খুব পরিষ্কার, তারা চায় সব রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে তুলে আনুক উপকূলের মানুষের জীবনমানের নিরাপত্তায় টেকসই বেড়িবাঁধ।

সাতক্ষীরার উপকূল ঘুরে দেখা গেছে, ষাটের দশকে নির্মিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধের ত্রিশ কিলোমিটারের বেশি বাঁধ রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। যে কোন প্রাকৃতিক দূযোগে এসব ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয় উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা। এভাবে সিডর, বুলবুল, আইলা, ফনি ও আম্ফান সহ নানা নামের ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে বার বার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে সাতক্ষীরার উপকূলের বেড়িবাঁধ। এসময় কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদীর লোনা পানি ঢুকে প্লাবিত করেছে উপকূলের জনবসতি ও ফসলের ক্ষেত। বিধস্ত হয়ে ঘরবাড়ি, ভাসিয়ে নিয়ে গেছে পশু ও ঘেরের মাছ। সহায়সম্বল হারিয়ে নিস্ব হয়েছে বহু পরিবার। বসতভিটাসহ সবকিছু হারিয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে অনেক পরিবার। টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকার কারণে প্রাকৃতিক দূর্যোগে এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলার উপকূলের মানুষ।

আশাশুনির বিছট গ্রামের রুহুল আমিন মোড়ল বলেন, নদী ভাঙনে আমাদের পরিবারের প্রায় ১০ বিঘা চাষের জমি নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। খোলপেটুয়া নদী গ্রাস করেছে বিছট গাজীবাড়ি জামে মসজিদ, বিছট মোড়ল বাড়ি জামে মসজিদ, বিছট ইফতেদায়ি মাদ্রসা সহ বহু ঘরবাড়ি। খোলপেটুয়া নদীর ভয়াবহ ভাঙনে এখন হুমকির মধ্যে রয়েছে আমাদের বসতবাড়িসহ পারিবারিক কবরস্থান ও ঈদগাহ ময়দান। নদী ভাঙন ঠেকাতে পাউবো কর্তৃপক্ষ বেড়িবাঁধের কাজ করলেও ঠিকাদারের দূর্নীতি ও অনিয়মের কারণে বাঁধের কাজ ঠিকমত হয় না। ফলে বার বার ভাঙতে ভাঙনে এখন আমাদের ঘরবাড়ি নদীতে যাওয়া উপক্রম হয়েছে। নদী ভাঙনের শিকার হয়ে বিছট গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবার গৃহহারা হয়ে এখন বেড়িবাঁধের উপর মানবেতর জীবন যাপন করছে।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতারা শুধুমাত্র ভোটের সময় এলাকায় আসা যাওয়া করেন। ভোট শেষে আর আমাদের খোঁজ খবর নেন না। এজন্য আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারি প্রার্থীদের কাছ আমাদের একটাই দাবি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যেন উপকূলের মানুষের যানমাল রক্ষায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের অঙ্গিকার থাকে।

শ্যামনগর উপজেলার দূর্গাবাটি গ্রামের ধীরেন্দ্রনাথ রপ্তান বলেন, দেশের দক্ষিণ উপকূলের মানুষের আর্তনাদ আজ রাজনীতিবিদদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না অথবা তারা তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার আগে বা পরে উপকূলবাসীর কথা মনে রাখছেন না।

আশি বছর বয়সী ধীরেন বলেন, বেড়িবাঁধ ভেঙে তিনি ও তার পরিবার অন্ততঃ সাতবার গৃহহারা হয়েছেন। এখন তিনি মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এরকম খারাপ অবস্থায় এলাকা ছাড়ার সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। তাই এলাকার মানুষ এখন প্রার্থীদের কাছে সরাসরি দাবি তুলছে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডাতে উপকূলবাসীর জন্য কী করবে তা স্পষ্ট করুক।
জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে দিনের পর দিন জলবন্দী দিনযাপন আর ঘরবাড়ি ভেঙে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া অশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর, আনুলিয়ার বিছট, কাকবসিয়া, শ্রীউলার হাজারাখালি, হিজলা-ঘোলা, শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুর, রমজাননগর, মুন্সিগঞ্জ, কৈখালীসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ দরিদ্র থেকে হতদরিদ্র হয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে উপকূলবাসীর কথা রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে তুলে ধরার জন্য আহ্বান জানান শ্যামনগর উপজেলার জেলেখালী গ্রামের রঞ্জন কুমার রপ্তান।

রাজনীতিবিদরাই দেশের নীতি নির্ধারণ করে থাকেন আর নির্বাচিত রাজনৈতিক দলগুলোই নির্ধারণ করেন দেশের মানুষের সংকট সমাধানে কী করতে হবে। আসছে নির্বাচন তৎপর হয়ে পড়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দের এই নির্বাচনী প্রস্তুতির সাথে দেশের সব থেকে দুর্যোগকবলিত মানুষের কথা যথাযথ ভাবে উঠে আসছে না এমনই কষ্টের অভিব্যক্তি জানালেন, শ্যামনগর উপকূলের শ্রীফলকাটি গ্রামের নারী রেকসানা বেগম।

বুড়িগোয়ালিনীর মৎস্যচাষী শওকত হোসেন বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে অবকাঠামোগত, শিক্ষা, চিকিৎসা, অর্থনৈতিক, সামাজিক, কৃষি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় সামগ্রিক ও টেকসই উন্নয়ন, এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় সংযোগ স্থাপন ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য উপকূলীয় উন্নয়ন বোর্ড গঠন করতে হবে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ সাবেক অধ্যক্ষ আশেক ই এলাহী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন আজ মানবতার জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। ১৯৯১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ ১৯৭টি বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে যা এদেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, সম্পদ, খাদ্য, পানি, বাসস্থানসহ অন্যান্য সংকট সৃষ্টি করেছে। এ সংকট দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে ক্রমশঃ আরো প্রকট হচ্ছে। এজন্য উপকূল রক্ষায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে প্রার্থীদের নির্বাচনী ইশতেহারে সুনির্দিষ্ট অঙ্গিকার থাকা দরকার।

জলবায়ু পরিবর্তন ও উপকূল সংকট নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন লিডার্সের সদস্য অসিত মন্ডল বলেন, নির্বাচন আসন্ন আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রস্তুত করতে দেশের সব মানুষের মতামত চেয়েছেন। নিশ্চয় অন্যদলগুলোও সেই কাজের দিকে হাঁটছে। সব দলের মধ্যে নির্বাচনী ইশতেহারে উপকূলের কথা থাকা খুব জরুরি।

সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদ জানান, ভৌগলিক অবস্থান, ঘনঘন প্রতক দুর্যোগ ভঙ্গুর অবকাঠামো, দারিদ্র্য, দীর্ঘমেয়াদী লবণাক্ততা, সংকটাপন্ন কৃষি প্রভৃতির কারণে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট উপকূলীয় এলাকার মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকার মানুষ, প্রকৃতি, ও জীবন জীবিকার সুরক্ষার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

সাতক্ষীরা-২ আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যার্শী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাবেক অধ্যক্ষ আবু আহমেদ বলেন, বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক ঘোষিত ‘নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮ সম্মৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ এর ৩.২৩ অনুচ্ছেদে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার ওপর গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সংযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে ভুক্তভোগীদের নতুন জায়গায় স্থানান্তর, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড-এর কার্যক্রম বাড়ানো, নগরকেন্দ্রিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলার রূপরেখা, পানি সমস্যার সমাধানের বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক তরিকুল হাসান বলেন, উপকূলবাসী ও জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুকে তার দল বারবার সামনে এনেছে। বিএনপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮-এ জলাবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় টেকসই কৌশল গ্রহণের আওতায় উপকূলসহ সারাদেশে নিবিড় বনায়ন ও সুন্দরবনসহ অন্যান্য বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষায় যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সাতক্ষীরা জেলা কমিটির সভাপতি ওবায়েদুস সুলতান বাবলু জানান, জাসদ এ ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়েছে সে কারণে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় জাতীয় নীতি প্রণয়ন, লোকজ জ্ঞানের ব্যবহার, স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানো সহ বিভিন্ন অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

জাতীয় পার্টি সাতক্ষীরা জেলার সাধারণ সম্পাদক আশরাফুজ্জামান আশু জানান, জাতীয় পার্টির ১৮ দফা সম্বলিত নির্বাচনী ইশতেহারে শুধুমাত্র নদী ভাঙনে গৃহহীনদের জন্য পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছে।

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে উপকূলীয় মানুষের উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার সংযুক্ত করার দাবিতে উপকূলের মানুষের ইশতেহার শীর্ষক উপকূল সংলাপে সাতক্ষীরার উপকূলে বারবার দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত নারীপুরুষদের দাবির পরিবর্তে আকুতি প্রকাশ করতে দেখা যায়। উপকূলবাসী প্রাণ থেকে জোরেসোরে প্রধানতম যেসব দাবি তুলছেন তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা অগ্রজ হলো, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি উপকূল টেকানোর প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ সুন্দরবনকে সুরক্ষার দাবি। সুন্দরবনের সম্পদ উপকূলের মানুষের জীবন জীবিকার অন্যতম উৎস এবং এর রয়েছে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধারা। সুন্দরবন দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের রক্ষা কবচ। বিভিন্ন কারণে সুন্দরবন হুমকির সম্মুখীন। উপকূলীয় অঞ্চলকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার জন্য ব্যাপক হারে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ, সবুজ বেষ্টনী তৈরি, নদীর চর বনায়ন সহ সুন্দরবন সুরক্ষায় স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়া। সুন্দরবন না থাকলে শুধু উপকূল অরক্ষিত হবে তা না। অরক্ষিত হবে গোট বাংলাদেশ।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!