কখনো যদি মে মাসে মিনেসোটার রাইস লেকের তীরে যান, তাহলে হয়তো জলজ উদ্ভিদের মাঝে দেখতে পাবেন একদল বিশালাকার মাছ। এই মাছগুলো হলো বিগমাউথ বাফেলো ফিশ, বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘায়ু মিঠাপানির মাছ। এদের কেউ কেউ ১০০ বছরেরও বেশি আয়ু পায়।
বিগমাউথ বাফেলোর ওজন ২৩ কেজি ছাড়িয়ে যায় অনেকসময়। প্রতি বছর এই বিশাল মাছ রাইস নদী পেরিয়ে লেকে আসে ডিম দিতে। তবে এই নিয়মিত প্রজনন কার্যক্রমের পেছনে আছে গোপন সংরক্ষণ সমস্যা- গত ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে এখানকার নতুন প্রজন্মের কোনো মাছ পূর্ণবয়স্ক হতে পারেনি।
বিগমাউথ বাফেলো দীর্ঘদিন বিজ্ঞানীদের নজরের বাইরে ছিল। তবে গত কয়েক বছরে বিজ্ঞানীরা এই মাছের অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নতুন করে জানছেন। দীর্ঘ আয়ুষ্কাল ও অবিশ্বাস্য সহনশীলতা দিয়ে অনন্য এই মাছ বিজ্ঞানীদের যতটা মুগ্ধ করেছে, তাদের মধ্যে ঠিক ততটাই উদ্বেগ তৈরি করেছে মাছটির টিকে থাকার হুমকি।
বিগমাউথ বাফেলো উত্তর আমেরিকার স্থানীয় প্রজাতি। কানাডার সাদার্ন সাসকাচেওয়ান ও ম্যানিটোবা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা ও টেক্সাস পর্যন্ত এ মাছের দেখা মিলে। সাধারণ মানুষ ও মাছশিকারিরা একে ‘অকাজের মাছ’ হিসেবেই দেখে। অর্থাৎ তাদের চোখে এ মাছ বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাই কেউ একে বিশেষ গুরুত্বও দেয় না। এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই বিগমাউথ বাফেলো দীর্ঘদিন বিজ্ঞানীদের নজর কাড়তে পারেনি।
তবে গত পাঁচ বছরে গবেষকরা বিগমাউথ বাফেলো নিয়ে অনেকগুলো নতুন ও বিস্ময়কর তথ্য জেনেছেন।
বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, এই মাছ ১২৭ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। মিঠাপানির আর কোনো মাছ এতদিন বাঁচে না।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিগমাউথ বাফেলো বুড়িয়ে যায় না।
গবেষকরা ধারণা করছেন, বিগমাউথ বাফেলোর স্থিতিশীল জনসংখ্যার পেছনে রয়েছে তাদের লম্বা আয়ুষ্কাল। পুরোনো মাছগুলো এখনও মারা যাচ্ছে না; যদিও নতুন প্রজন্ম প্রাপ্তবয়স্ক হতে পারছে না।
তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, মাছটির জনসংখ্যা হঠাৎ করেই ব্যাপক কমে যেতে পারে।
বিগমাউথ বাফেলো নিয়ে গবেষণার অন্যতম প্রধান, মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অ্যালেক ল্যাকম্যান। এই মৎস্য বিশেষজ্ঞ বিবিসিকে বলেন, ‘এটি বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন প্রাণীগোষ্ঠীগুলোর একটি, অথচ এই প্রজাতি নিয়ে কোনো ব্যবস্থাপনা বা সংরক্ষণ ব্যবস্থা নেই।’
২০১৯ সালের যে গবেষণায় প্রথমবারের মতো মিনেসোটার বিগমাউথ বাফেলোর শতবর্ষী জীবনকাল আবিষ্কৃত হয়, সেই গবেষণার নেতৃত্ব দেন ল্যাকম্যান। এর আগে মনে করা হতো, এই মাছের গড় আয়ু মাত্র ২৬ বছর। পরবর্তীতে ল্যাকম্যান উত্তর আমেরিকার অন্যান্য অংশেও এই প্রজাতির বহু শতবর্ষী সদস্যের অস্তিত্ব খুঁজে বের করেন।
মাছের বয়স বের করা হয় অটোলিথের মাধ্যমে। অটোলিথ হচ্ছে মাছের কানের ভেতরে থাকা পাথরসদৃশ কাঠামো। অটোলিথ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাছের বলয়ের মতো স্তর তৈরি করে। এই অটোলিথকে অতি সরু টুকরোয় কেটে এর বলয়গুলো গণনা করে মাছের বয়স নির্ভুলভাবে জানা যায়।
ল্যাকম্যান জানান, প্রথম যে বিগমাউথ বাফেলোর অটোলিথ বিশ্লেষণ শুরু করে বয়স নির্ধারণ করেছিলেন, সেটি ছিল প্রায় ৯০ বছর বয়সি। মাছটির বয়স দেখে তিনি হতবাক হয়ে যান। কয়েক বছর পর তিনি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ শুরু করেন বিগমাউথ বাফেলো নিয়ে। ২০২১ সালে তাদের ওই গবেষণার ফলাদল প্রকাশিত হয়।
গবেষণার সহলেখক এবং নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানী ব্রিট হেইডিঙ্গার বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাছগুলোর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দুর্বল হয়নি।’
প্রাণীর ডিএনএর ক্রোমোসোমের দুই বাহুর শেষ প্রান্তকে বলা হয় টেলোমিয়ার। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য ছোট হয়। কিন্তু বয়স বাড়লেও বিগমাউথ বাফেলোর টেলোমিয়ার ছোট হতে দেখা যায়নি। বরং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ মাছের ইমিউন সিস্টেম আরও ভালো হয়েছে বলে ধারণা পাওয়া গেছে। সেইসঙ্গে নিউট্রোফিল-টু-লিম্ফোসাইট অনুপাত কমে যাওয়ায় বিগমাউথ বাফেলো সম্ভবত বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের চাপ সামলানোতে আরও দক্ষ হয়ে ওঠে এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
হেইডিঙ্গার বলেন, এই মাছ কীভাবে এত দীর্ঘ সময় ধরে স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে পারে, তা এখনও বোঝা যায়নি। বিগমাউথ বাফেলো সম্ভবত এমন কোনো এনজাইম ব্যবহার করে যা তাদের টেলোমিয়ারকে ছোট হতে দেয় না। তবে টেলোমিয়ার থেকে বিগমাউথ বাফেলোর সর্বোচ্চ জীবনকাল বা বয়সের সঙ্গে স্বাস্থ্য ভালো হওয়ার এই ধারা অব্যাহত থাকবে কি না, তা জানা সম্ভব নয়। কারণ বয়স বৃদ্ধি সরলরেখৈক প্রক্রিয়া নয়।
তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় আরেকটি বিষয় বিজ্ঞানীদের বিভ্রান্তিতে ফেলেছে। গবেষণার সময় পাওয়া মাছগুলোর বিরাট একটি অংশই ছিল অত্যন্ত বয়স্ক। এ থেকে নতুন একটি প্রশ্ন উঠে আসে: অল্পবয়সি মাছগুলো গেল কোথায়?
ল্যাকম্যান ও তার সহযোগীরা সাম্প্রতিক এক গবেষণাপত্রে জানান, তাদের সংগ্রহ করা ৩৯০টি বিগমাউথ বাফেলো ফিশের মধ্যে ৯৯.৭ শতাংশ (৩৯০টির মধ্যে ৩৮৯টি) মাছের বয়সই ৫০ বছরের বেশি। গড় বয়স ৭৯ বছর- অর্থাৎ সংগ্রহ করা এই মাছগুলোর বেশিরভাগের জন্মই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, প্রতি বছর মে মাসে বিগমাউথ বাফেলো সফলভাবে প্রজনন করে প্রচুর বাচ্চা জন্ম দিলেও গ্রীষ্মের শেষ নাগাদ এরা সবাই স্রেফ উধাও হয়ে যায়। সত্যি বলতে কী, ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে এ মাছের তরুণ প্রজন্ম প্রাপ্তবয়স্ক হতে পারেনি। ল্যাকম্যান বলেন, ‘১৯৫৭ সালের পর জন্ম নেওয়া প্রতিটি বাচ্চা মাছই পরিসংখ্যানগতভাবে ব্যতিক্রম।’
গবেষকদের মতে, বাচ্চা মাছগুলোর কম টিকে থাকার কারণ সম্ভবত আরেকটি স্থানীয় মাছ: পাইক। পাইক মাছও রাইস লেকে ডিম ছাড়ে, তবে কিছুটা আগে। তাই বিগমাউথ বাফেলো মাছের বাচ্চাগুলো সম্ভবত পাইক মাছের বাচ্চাদের শিকার হয়ে যায়।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, বিগমাউথ বাফেলোর অত্যন্ত দীর্ঘ আয়ুষ্কাল আসলে এমন একটি অভিযোজন, যা তাদের অল্পসংখ্যক সফল প্রজন্মের জন্য প্রস্তুত করেছে। তবে বিষয়টি নিশ্চিত হতে আরও গবেষণার প্রয়োজন।
রাইস লেক ন্যাশনাল ওয়াইল্ডলাইফ রিফিউজ-এর ব্যবস্থাপক এবং গবেষণার সহলেখক ওয়াল্ট ফোর্ড বলেন, বিগমাউথ বাফেলো হয়তো শুরু থেকেই দীর্ঘজীবী ছিল; তাই তাদের ওপর নতুন প্রজন্ম তৈরির চাপ কখনোই এত বেশি ছিল না। অথবা নতুন প্রজন্ম টিকিয়ে রাখার কঠিন পরিস্থিতি হয়তো তাদের দীর্ঘজীবী হতে বাধ্য করেছে।
এই ৬০ বছরের প্রজন্মশূন্যতা কতটা অস্বাভাবিক, তা এখনও অজানা। এছাড়া এই প্রজাতির সর্বোচ্চ জীবনকাল কত, তা-ও এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। রাইস লেকের বিগমাউথ বাফেলো অন্য জলাভূমির মাছেদের সঙ্গে মিশে থাকতে পারে। তবে এ পর্যন্ত গবেষণা করা বেশিরভাগ বিগমাউথ বাফেলো ফিশের জনসংখ্যায় বয়স্ক মাছের আধিক্য দেখা গেছে।
হেইডিঙ্গার বলেন, ল্যাকম্যানের গবেষণার সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো এই উপলব্ধি যে প্রাপ্তবয়স্ক মাছের মৃত্যুহার বাড়লে এই প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। এছাড়া বর্তমানে কতসংখ্যক বিগমাউথ বাফেলো টিকে আছে, তা কেউ জানে না।
প্রাপ্তবয়স্ক বিগমাউথ বাফেলো ফিশকে শিকার করার মতো কোনো প্রাপ্তবয়স্ক শিকারিও নেই- এক মানুষ ছাড়া। কানাডায় এ প্রজাতিকে বিশেষভাবে সংরক্ষণযোগ্য এবং পেনসিলভানিয়ায় বিপন্ন ঘোষণা করা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের বাকি অংশে এদের সংরক্ষণের জন্য কার্যত কোনো উদ্যোগ নেই। এছাড়া বোফিশিং-এর জনপ্রিয় টার্গেট বিগমাউথ বাফেলো।
ল্যাকম্যান বলেন, সংরক্ষণ এবং জনসচেতনতা এই মাছ রক্ষার মূল চাবিকাঠি। অনেকেই ভুলে বিগমাউথ বাফেলো ফিশকে আগ্রাসী কার্প প্রজাতি ভেবে বাস্তুতন্ত্র রক্ষার নামে এদের সরিয়ে ফেলেন। অথচ বিগমাউথ বাফেলো আসলে স্থানীয় প্রজাতি এবং আগ্রাসী প্রজাতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে।
খুলনা গেজেট/এএজে