খুলনার বর্ষীয়ান রাজনীতিক, ভাষা সংগ্রামী ও নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এড. মঞ্জুরুল ইমাম হত্যার সাথে কারা জড়িত ? এ প্রশ্নের জবাব আজও মেলেনি। ২০১৮ সালে আসামির ডেথরেফারেন্স ও আপিলের ওপর রায় ঘোষণার দিনে হাইকোর্ট বিব্রত বোধ করলে প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো হয় তা। শাসক দল বিভিন্ন সময় বলেছে, এ হত্যার সাথে বিএনপি জড়িত। অপরদিকে বিএনপি বলেছে, আওয়ামী লীগের ভেতরেই আছে এড. মঞ্জুরুল ইমামের খুনীরা। এভাবেই কেটে গেছে ১৯ টি বছর।
২০০৩ সালের ২৫ আগস্ট প্রকাশ্যে দিবালোকে বাসভবনের অদূরে তিনি সহ মোট তিন জন খুন হন। ঘটনার দিনই মঞ্জুরুল ইমামের ছেলে আবদুল্লাহ আল মামুন বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে খুলনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি মামলা করেন। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ২০০৮ সালের ০১ সেপ্টেম্বর হত্যা মামলা অংশের রায়ে আসামিরা সকলে বেকসুর খালাস পায়। ২০১১ সালের ১৭ এপ্রিল বিস্ফোরক অংশের রায়ে চরমপন্থী শুকুর গাজীর মৃত্যুদন্ড এবং শেখ আব্দুল বারী রিপন ও গনেশ ব্যানার্জী খালাস পায়।
২০১৮ সালের ৪ জুলাই বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোঃ কামরুল হোসেন মোল্যার হাইকোর্ট বেঞ্চে এ হত্যা মামলা রায়ের জন্য রাখা হয়। ১১ জুলাই হাইকোর্ট বেঞ্চ আসামির ডেথরেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিলের ওপর রায় ঘোষণার দিনে বিব্রতবোধ করায় প্রধান বিচারপতির কাছে তা পাঠানো হয়।
এ আদালতের ডেপুটি এ্যাটর্নী জেনারেল বশির আহম্মেদ সাংবাদিকদের জানান, আদালত রায় দিতে বিব্রতবোধ করায় কার্যতালিকা থেকে বাদ দিতে আদেশ দিয়েছে। তিনি জানান, এখন নিয়ম অনুযায়ী মামলার কাগজপত্র প্রধান বিচারপতির কাছে যাবে। প্রধান বিচারপতি শুনানীর জন্য নতুন বেঞ্চ গঠন করে দেবেন। পারিবারিক সূত্র আজও ফলাফল জানতে পারেনি।
গত বছর এড. মঞ্জুরুল ইমামের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, এ হত্যার সাথে বিএনপি জড়িত। এরপর ২৮ আগস্ট খুলনার বিএনপির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, আওয়ামী লীগের ভেতরেই আছে এড. মঞ্জুরুল ইমামের খুনীরা। দু’টি রাজনৈতিক দলের পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে নগরবাসীর কাছে এ হত্যার পেছনে মদদদাতাদের নাম পরিচয় স্পষ্ট হয়নি। তবে বিচারিক আদালতে প্রয়াত মঞ্জুরুল ইমামের বড় ছেলে আবদুল্লাহ হারুন রুমীর দেয়া সাক্ষ্য বিশেষ ইঙ্গিত বহন করে বলে আদালত সূত্র জানায়।
দীর্ঘ দেড় যুগেও এড. মঞ্জুরুল ইমাম হত্যার রহস্য খুলনাবাসীর কাছে অজানা থাকলেও তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে সবাই। প্রতি বছর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর আদর্শ লালন করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও খুলনায় আরেকজন মঞ্জুরুল ইমাম তৈরি হয়নি।
মাধ্যমিক শিক্ষা জীবনের শুরুতেই মঞ্জুরুল ইমাম ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হন। সেই থেকে তার রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। খুলনা জিলা স্কুলে অধ্যয়নকালে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন। সহপাঠিদের নিয়ে তিনি নিয়মিত মিছিলে অংশ নিতেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির পক্ষে দেয়া নেতাদের যুক্তিটি সহপাঠিদের কাছে পৌঁছে দিতেন। তৎকালিন মিউনিসিটিপ্যাল পার্কে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সভা-সমাবেশে অংশ নিয়েছেন। সময়টিতে সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী তার সহপাঠী ছিলেন বরেণ্য রাজনীতিক কাজী জাফর আহম্মেদ (পরবর্তীতে এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী) ও বাম রাজনীতিক সিরাজুল আলম খান (৭১ এ মুজিববাহিনীর অধিনায়ক)। তারাও তাদের জীবনীতে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের কথা বর্ণনা দিয়েছেন। খুলনা নগরীর কাঁঠালতলা মোড়ে (আজকের নুর অপটিক্যাল এর মোড়) ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার আজাদ লাইব্রেরীতে কৌতুহলী এ শিশু শিক্ষার্থীদের পদচারণা ছিল। ভাষা আন্দোলনের সংগঠক ও তৎকালীন বাম রাজনীতিকদের সাথে তার আলাপ ও সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে । মূলত: ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের রাজনীতিতে হাতে খড়ি। পরবর্তীতে তিন জন তিন দর্শণে বিশ্বাসী হয়ে পড়েন। পূর্ণ বয়সে এ তিন জন হয়ে ওঠেন দেশের খ্যাতিমান রাজনীতিক। দক্ষিণ জনপদের মানুষ ভাষা সৈনিক এ গর্বিত সন্তানকে যুগ যুগ স্মরণ করবে। ছাত্র, কর্ম ও রাজনৈতিক জীবনে তার অবদান খুলনাঞ্চলের মানুষের কাছে চিরস্মরণীয়।
মঞ্জুরুল ইমাম শহরের বয়রা এলাকার সন্তান। ১৯৩৯ সালের ৯ নভেম্বর নওয়াপাড়ায় নানা বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের অধিকাংশ সময় সাউথ সেন্ট্রাল রোড ও সামছুর রহমান রোডে কাটিয়েছেন।
শেখ মোঃ ইউনুস তার পিতা, ফাতেমা বেগম মা। ১৯৫৬ সালে জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৫৯ সালে বিএল কলেজ থেকে আইএ, ১৯৬১ সালে একই কলেজ থেকে বিএ ও ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে খুলনা শহর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক, ১৯৮২ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত মহানগর শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫২ সালে জিলা স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভুমিকা পালন করেন (অধ্যক্ষ জাফর ইমামের স্মৃতিচারণ)। ১৯৯৫ সালে খুলনা সেন্ট্রাল ল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। ১৯৯৬-৯৮ জাতীয় সমবায় ব্যাংকে ডাইরেক্টর, ল্যান্ড মর্টগেজ ব্যাংকে চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিস ট্রাস্টের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে খুলনা-২ আসনে সংসদ সদস্য প্রার্থী ছিলেন।
খুলনা গেজেট/ টি আই