খুলনার দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক সহ-সভাপতি মাহবুবুর রহমান হত্যাকান্ডের নেপথ্যে ৭ কারণ সামনে রেখে তদন্ত করছে পুলিশের তিনটি টিম। ইতোমধ্যেই ঘটনাস্থলের আশপাশের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে খুনিদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তবে হত্যার ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর আতাহার আলী বলেন, মাহবুবুর রহমানকে শুক্রবার জুমার নামাজের আগে নগরীর মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়ায় নিজ বাড়ির সামনে গুলি ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করা হয়। হত্যাকান্ডের একদিন পর শনিবার দুপুরে নিহতের পিতা মো. আব্দুল করিম মোল্লা বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এদিকে শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়ায় নিহত মাহবুবের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের সাথে কথা বলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আবু সালেহ মোহাম্মাদ রায়হান জানান, তারা একাধিক বিষয় সামনে রেখে তদন্ত শুরু করেছেন। হত্যাকান্ডে একাধিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। হত্যাকান্ডে একটি মোটরসাইকেলে তিনজন কিলার অংশ নেয়। তাদের মধ্যে একজনের মাথায় হেলমেট ছিল। আশপাশের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এই ফুটেজ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে খুনিদের ধরা হবে। খুব শীঘ্রই খুনীরা ধরা পড়বে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খুনীরা দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত।
হত্যাকান্ডের নেপথ্যে ৭ কারণ
যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান হত্যার নেপথ্যে সাত কারণ থাকতে পারে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, দলীয় কোন্দল, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, চাঁদাবাজী, মাদক ব্যবসা, চরমপন্থীদের সাথে কানেকশন ও খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সাথে মারামারির ঘটনাগুলো নিয়ে তদন্ত কাজ শুরু করা হয়েছে।
একটি সূত্র জানায়, ৫ আগষ্টের আগেও মাহবুবুর রহমানের বাড়িতে হামলা হয়েছিল। এছাড়া গত বছরের ৪ আগষ্ট বিএল কলেজ রোডে বিএনপি অফিস ভাংচুর ঘটনায় ২১ আগষ্ট বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন মাহবুবুর রহমান। মামলায় ৫২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ১৫০-২০০ আসামি করা হয়। মামলাটি প্রত্যাহার করার জন্য মাহবুবুর রহমানকে প্রায় সময়ই হুমকি-ধামকি দেওয়া হতো। এছাড়া গত ১ অক্টোবর সন্ধ্যায় মানিকতলা শহীদ মিনার চত্তরে ১নং ওয়ার্ড বিএনপি আয়োজিত সূধী সমাবেশে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারি হয়। পরের দিন ২ অক্টোবর বিএনপি নেতা জাকির হোসেন বাদী হয়ে ৪৫ জনের নাম উল্লেখ করে আরো অজ্ঞাত ১০০-১৫০ জনকে আসামি করা হয়। মামলাকে কেন্দ্র করে অভ্যান্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্য আকার ধারণ করলে জাকির ও মাহবুবকে হুমকি দেওয়া হতো। হুমকির কারণে জাকির প্রায় ৮ মাস ধরে বাড়ি থেকে বের হন না। বাড়ি থেকে বের না হওয়ার জন্য মাহবুবুর রহমানকে নিষেধ করতেন জাকির। কিন্তু মাহবুব সে কথা শোনেননি।
সূত্রটি আরও জানায়, এলাকার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ২-৩টি সন্ত্রাসী গ্রুপের সাথে মাহবুবুর রহমানের বিরোধ ছিল। এছাড়া মাদকের কেনা-বেচা এবং চাঁদাবাজী নিয়ে একাধিক গ্রুপের টার্গেট ছিল মাহবুব। স্থানীয় চরমপন্থীদের সাথেও বিরোধ সৃষ্টি করে রেখেছিলেন তিনি।
এছাড়া গত ১৮ ফেব্রুয়ারি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সাথে মারামারির ঘটনায় অস্ত্র হাতে একটি ছবি ভাইরাল হওয়ার পর মাহবুবকে দল থেকে সাময়িক বহিস্কার করা হয়। ওই ঘটনার পর একটি ছাত্র সংগঠনের সাথে তার বিরোধ ছিল। হত্যাকান্ডে ঘটানোর আগে বেশ কয়েকবার ওই এলাকায় খুনীরা মহড়া দেয়।
এদিকে শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় নিহত মাহবুবুর রহমানের বাড়ীতে গিয়ে শোকের মাতম দেখা যায়। তার স্ত্রী ও দুই মেয়ে বার বার মুর্ছা যাচ্ছিলেন।
নিহত মাহবুবের চাচা মোঃ শহীদ মোল্লা বলেন, ৫ আগষ্টের আগে মাহবুবকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। সে সবসময়ই মাদক ব্যবসায়ী, চাদাঁবাজদের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে শত্রু বেড়ে যায়। তাকে প্রায়ই হুমকি দেওয়া হতো। এলাকার ২-৩টি সন্ত্রাসী বাহিনীর সাথেও তার বিরোধ ছিল। এক সপ্তাহ আগেও মাহবুবকে গুলি করে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
মাহবুবের শ্বশুড় আজাদ বেগ বাবু বলেন, বিএনপি অফিস ভাংচুর মামলার বাদী হওয়া এবং শিরোমনিতে মারামারির ঘটনায় তার উপর হুমকি ছিল। মামলার আসামি হওয়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর তার উপর বিরাগভাজন ছিল। এছাড়া কুয়েটের ঘটনায় যুবদলের নেতা হিসেবে মাহবুব ছাত্রদলের পাশে দাড়ায়। একারণে একটি ছাত্র সংগঠনের সাথে তার বিরোধ ছিল।
এদিকে মাহবুবেবর সাথে সার্বক্ষণিক থাকতো তারই চাচাতো ভাই আশরাফুল মোল্লা। এই ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, মুলত শিরোমনিতে মারামারির ঘটনার পর মাহবুবের শত্রু বেড়ে যায়। এঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নামে মামলা করায় তারা ক্ষিপ্ত ছিল। প্রায়ই হুমকি দেওয়া হতো।
দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর আতাহার আলী বলেন, আমরা বেশকিছু বিষয় সামনে রেখে তদন্ত করছি। তদন্তের স্বার্থে আপাতত কিছুই বলা যাচ্ছেনা। থানা পুলিশের দুটি এবং গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি টিম তদন্তে কাজ করছে।
তিনি বলেন, ঘটনার সময় উপস্তিত ভ্যান চালককে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ঘটনার সময় ওই ভ্যান চালককে তিনি ডেকে নিয়ে গাড়ি পরিস্কারের কাজে অংশ নিতে বলেন। ওই ভ্যান চালকের সামনে একটি মোটরসাইকেল আসা তিন ব্যক্তি তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। দু’টি গুলির একটি তার মুখের ডান পাশে এবং মাথার ডান পাশে বিদ্ধ হয়। এরপর তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তার দু’পায়ের রগ কেটে দেয়। পরবর্তীতে সন্ত্রাসীরা ওই ভ্যান চালককে লক্ষ্য করে আরও দু’টি গুলি ছোড়ে । কিন্তু ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান।
খুলনা গেজেট/সাগর/এমএম