যশোর প্রধান ডাকঘরের সাবেক সহকারী পোস্ট মাস্টার আব্দুল বাকী প্রায় দু’কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনার তদন্তে উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। টাকা আত্মসাতের বিষয়ে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি ইতিমধ্যে তদন্ত কমিটির কাছে স্পষ্ট হয়েছে। ইতিমধ্যে তিনি ১৪ লাখ টাকা ডাকঘরের অনুকূলে জমা দিয়েছেন। বিষয়টি গুরুত্বের সাথেই তদারকি করছেন ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হারুনুর রশীদ নিজেই।
সোমবার সকালে তিনি যশোর হেড পোস্ট অফিসে আসেন সরেজমিন পরিদর্শনে। এ সময় খুলনা অঞ্চলের কর্মকর্তাদের সাথে তিনি বৈঠক করেন।
এদিকে, খুলনার পোস্টমাস্টার জেনারেল কর্তৃক গঠিত কমিটির তদন্তে উঠে এসেছে নতুন তথ্য। আব্দুল বাকী যশোর পোস্ট অফিসের সিসি ক্যামেরার সকল ফুটেজ ডিলিট করে দিয়েছেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
এছাড়া, যে ১৭ আমানতকারীর উত্তোলন ফর্মের মাধ্যমে টাকা তুলে নেয়া হয়েছে তার প্রত্যেকটিতেই রয়েছে বাকীর নিজ হাতের লেখা। শুধু টাকা উত্তোলন ফর্ম না, ওই ১৭ জনের লেজার ও পাস বইতে বাকীর হাতে লেখা টাকার অঙ্ক বসানোর বিষয়টির প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। ওই ১৭ জনের মধ্যে কয়েকজনের জবানবন্দি নিয়েছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। এ ঘটনায় ডাক বিভাগ থেকে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারাও তদন্ত শুরু করেছেন। তদন্তের স্বার্থে আব্দুল বাকীর পিয়ন আক্কাস সিকদারকে খুলনার পিএমজি অফিসে বদলি করা হয়েছে। পোস্টাল অপারেটর মুস্তাকিম বিল্লাহকে বদলি করা হয়েছে যশোর ডিপিএমজিতে।
পোস্ট অফিস সূত্র জানায়, ৮ আগস্ট দক্ষিণাঞ্চল খুলনার পোস্ট মাস্টার জেনারেল কর্তৃক গঠিত কমিটির তদন্ত প্রায় শেষের দিকে। তদন্তের একপর্যায়ে ২ জানুয়ারি ডেপুটি পোস্ট মাস্টার মেহেরুননেছার সাথে অসদাচরণ এবং লেজার ও পাস বইসহ বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনার চিত্র দেখতে কমিটি সিসি ফুটেজ সংগ্রহের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। বাধ্য হয়ে এক্সপার্ট এনে জানতে পারেন ৫ ফেব্রুয়ারির আগের সকল ফুটেজ মুছে ফেলা হয়েছে। এই ডিভাইসের পাসওয়ার্ড ছিল কেবলমাত্র বাকীর কাছে। ওই তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, যে ১৭ জন গ্রাহকের পাস বই ব্যবহার করে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে সেই ১৭টি পাস বইতেই রয়েছে বাকীর হাতের লেখা। যা কাউন্টার অপারেটরের লেখার কথা। একই হাতের লেখা লেজারেও। যেখানে থাকবে লেজার অপারেটরের হাতের লেখা। তিন জায়গায় বাকীর হাতের লেখার প্রমাণ পেয়েছে এ কমিটি। এছাড়া, ওই ১৭ গ্রাহকের একজন পুরাতন কসবার আইয়ুব আলীর স্ত্রী কমলা তদন্ত কমিটির কাছে লিখিত জবানবন্দি দিয়েছেন।
সেখানে তিনি জানিয়েছেন, পোস্ট অফিসে সাধারণ হিসাব খোলার এক পর্যায়ে লেনদেন বন্ধ রাখেন। সর্বশেষ, ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে জমা থাকা পাঁচ হাজার টাকা উঠিয়ে আনতে গেলে নমুনা স্বাক্ষরে অমিলের দোহাই দিয়ে আব্দুল বাকী তাকে রুমে ডেকে নিয়ে যান। সে সময় তার সাথে ছেলে জাহিদ হাসানও ছিলেন। বাকী তাকে বলেন, পুরো টাকা উঠাতে ঝামেলা আছে। তিনি পাস বই রেখে তিনটি কাগজে সই করিয়ে নেন। পরের দিন ছেলেকে পাঠিয়ে দিতে বলেন। ছেলে জাহিদ হাসান পরের দিন গেলে তার কাছে মুনাফাসহ ৬ হাজার ২০০ টাকা দেন আব্দুল বাকী। রেখে দেন পাস বই।
তদন্তে উঠে এসেছে ২০২১ সালের ১০ মার্চ কমলার পাস বই ও লেজার বইয়ে সাড়ে ১৪ লাখ টাকা জমা দেখান বাকী। এরপর ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর ওই সাড়ে ১৪ লাখ টাকা উত্তোলন করে নেন তিনি। একইভাবে বিভিন্ন কৌশলে তিনি এক কোটি ৭৮ লাখ পাঁচ হাজার টাকা তিনি যশোর পোস্ট অফিস থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন। এরমধ্যে তিনি স্বজনদের মাধ্যমে ১৪ লাখ টাকা গত রোববার ডাকঘর কর্তৃপক্ষ বরাবরে জমা দিয়েছেন।
অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, মহাপরিচালক হারুনুর রশীদের নির্দেশে পৃথক আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। যার সভাপতি হয়েছেন দক্ষিণাঞ্চল খুলনার পোস্ট মাস্টার জেনারেল শামসুল আলম। সদস্য সচিব হয়েছেন ডেপুটি পোস্ট মাস্টার জেনারেল খন্দকার মাহাবুব হোসেন। সদস্যরা হলেন, অতিরিক্ত পোস্ট মাস্টার জেনারেল আমিনুর রহমান, সহকারী পোস্ট মাস্টার জেনারেল (নিরাপত্তা) ফিরোজ আহম্মেদ ও সুপার বাবুল আক্তার (তদন্ত)।
এ বিষয়ে দক্ষিণাঞ্চল খুলনার পোস্ট মাস্টার জেনারেল শামসুল আলম বলেন, আব্দুল বাকীর বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ডাক বিভাগ। যার নেতৃত্বে রয়েছেন তিনি নিজেই। তিনি বলেন, তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পরই তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এরপর দুদক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।
মহাপরিচালক হারুনুর রশীদ বলেন, যশোর অফিসের ভবন পরিদর্শনসহ আরও কয়েকটি পূর্ব নির্ধারিত কাজের অংশ হিসেবেই তিনি যশোরে এসেছেন। একইসাথে তিনি যশোর হেড পোস্ট অফিসও পরিদর্শন করেছেন। তিনি বাকীর বিষয়ে বলেন, গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করতে তারা বদ্ধপরিকর। যেটা ঘটেছে সেটা অনাকাঙ্খিত। তবে, জড়িত যেই হোক তাকে ছাড় দেয়া হবে না বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, শেখ মোহাম্মদ আলী নামে এক আমানতকারীর পাস বই দিয়ে জালিয়াতি করে ১৩ লাখ টাকা উঠানোর চেষ্টা করেন আব্দুল বাকী। এটি করতে গিয়েই হাতেনাতে ধরা পড়েন তিনি। এরপর উঠে আসে তার প্রায় দু’লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনা। এসব ঘটনায় মামলা দায়েরের পর আটক হয়ে বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
খুলনা গেজেট/ এসজেড