২০১২ সালের একটি ঘটনা। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চার তলার অন্ধকার নির্জন একটি করিডোর দিয়ে যাচ্ছি (রোগীর স্বজনদের ভিড় এড়ানোর জন্য)। শীতকালের রাত। বলা প্রয়োজন যে, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন অংশগুলো তখনও হয়নি । যে করিডোরটার কথা বলছি, তা দিনের বেলাতেও একরকম নির্জন থাকতো। হঠাৎ হিংস্র পশুদের গোঙানির মতো কিছু শব্দ। গাঢ় অন্ধকারে খুব ভয় পেলাম । দ্রুত পা চালিয়ে চলে আসলাম। মনের ভিতর খচখচ করতে থাকলো । কিছুক্ষন পর টর্চ হাতে ফিরে গেলাম সেখানে । আলো ফেলতেই আবছা অন্ধকারে যা দেখলাম, তা রীতিমতো বীভৎস। মানসিক ভারসম্যহীন বিকট চেহারার কেউ একজন। ঠিকমতো জ্ঞান নাই । ওঠার ক্ষমতা নাই । গোঙানির মতো বললেন, ‘‘ভাত, ভাত।’’ অন্য কথা বোঝা গেলো না । খাবার এনে দিলাম। পরেরদিন খাবার নিয়ে গিয়ে দেখলাম, ব্রস্ত্রহীন অতি ক্ষুধার্ত, জীর্ণ-শীর্ণ একজন মানুষ । গত রাতে অন্ধকারে আমি তা বুঝতে পারিনি ।
কিছুদিন পর ঘটনাটা আমার এক সহকর্মী, তৎকালীন সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রারকে জানালাম। তিনিও চেষ্টা করলেন, যাতে ব্যক্তিটি তার সামাজিক অবস্থানে পুন: প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন । বুঝতে পারলাম আমাদের মতো অনেকেই তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । ইতিমধ্যে তার পায়খানা-প্রস্রাব অনেক দূর পর্যন্ত বিকট গন্ধ ছড়ালে।চেষ্টা করেও অবস্থা সামলানো গেলো না । অনেকে যৌক্তিক অভিযোগ জানালো । কোনো এক সকালে খাবার দিতে এসে দেখলাম, স্থানটি শুন্য । পায়খানা-প্রস্রাব পরিষ্কার করা হয়েছে । বোকার মতো খাবারের প্যাকেট হাতে অনেক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলাম । কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কেউ জানে না। খাবারের প্যাকেটটি রেখে আসলাম শুধু এই আশায় যে, আমাদের পাগল যদি ফিরে আসে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো । সন্ধ্যা বেলা কতগুলো পাখিকে সেই খাবার খেতে দেখলাম । পাগল আর ফিরে এলো না।
বিগত বছর গুলোতে আমি বহুবার এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখিছি । এই হাসপাতালে নতুবা অন্য কোথাও । দেখিছি চিকিৎসক কিংবা সাধারণ কোনো মানুষকে শ্রম দিতে, অর্থ দিতে, খাবার দিতে । দেখিছি হাসপাতাল কিংবা সমাজ সেবা বিভাগকে পাশে এসে দাঁড়াতে । কিন্তু ফলাফল একই । কোনো এক পর্যায়ে এসব পাগলের সব কিছু ব্যর্থ করে অদৃশ হয়ে যায় । আর ফিরে আসে না । না ফিরে যেতে পারে স্বাভাবিক জীবনে । আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি যখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলাম, বহুবার এমনি সব ঘটনা দেখেছি । ফলাফল বরাবরই একই । অর্থ, সেবা, শ্রম, সহমর্মিতা সব স্তরের মানুষের মধ্যে থেকে এসেছে । কিছু তা সফল হয়নি। আমার ধারণা, সব হাসপাতালের অভিজ্ঞতা অনেকটা এরকমই । তাহলে কিসের অভাব?
অভাব সমন্বয়ের । যার জন্য প্রয়োজন, এধরণের ব্যক্তিদের জন্য পৃথক Rehabilitation Centre, যেখানে সমন্বয় সাধন সম্ভব । ‘রিহ্যাবিলিটেশন’ শব্দটাকে একটু ব্যাখ্যা করা যাক। যার মানে হলো, ক্ষতিগ্রস্থ কাউকে যতদূর সম্ভব তার নিজের স্বাভাবিক স্থানে পুন:স্থাপন করা । কালস্রোতে এসব অজ্ঞাতনামাদের গল্পগুলো এদের মতোই হারিয়ে যায়। বর্তমানে সম্প্রসারিত হচ্ছে প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল । ৫ থেকে ১০ বেডের ছোট্ট একটি Centre পারে এরকম অনেকের গল্পকে বহুদূর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে । কে জানে হয়তো এরকম অনেকেই ফিরে যেতে পারবে তাদের নিজেদের স্বাভাবিক স্থানে । অসমাপ্ত গল্পগুলো সমাপ্ত হবে ।
লেখক: FCPS, MS, MRCS, MCPS,
কনসালটেন্ট (সার্জারি বিভাগ),
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
খুলনা গেজেট/ টি আই