মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কথা হয় খুলনার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ৭১ বছর আগের কথা। পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পরে রাষ্ট্রভাষা কী হবে- এটা নিয়ে ঢাকায় তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দিলেন যে উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা। তাৎক্ষণিকভাবেই ঢাকা থেকে শুরু করে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। তখন খুলনায় মাত্র একটাই কলেজ ছিল, বিএল কলেজ। আমি ১৯৫২ সালে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। বিএল কলেজের ছাত্ররা বিভিন্ন স্কুলে চলে গেল। আমি তখন বিকে স্কুলের ছাত্র।
বিএল কলেজের ছাত্ররা এসে প্রথমে শিক্ষকদের সাথে কথা বললেন। তারা বললেন রাষ্ট্রভাষা বাংলা হতে হবে, মায়ের ভাষা, বুকের ভাষা। তখন শিক্ষকরাও বললেন- এটা আমাদের প্রাণের দাবি। শিক্ষকরাও সমর্থন দিলেন। ছাত্রদের বললেন- তোমরাও এসো। বড় ভাইয়েরা বক্তৃতা দিলেন- তোমাদেরকে প্রতিবাদ করতে হবে। আমরা তখন খুব উৎফুল্ল।
আমার তখন ১০/ ১১ বছর বয়স। আমাদের নিয়ে তখন তারা রাস্তায় মিছিল করলেন। তখন কিন্তু একটা মিছিলে ডিসিপ্লিন ছিল। মিছিল হতো দুটো লাইনে। ছাত্ররা দুটো লাইনে দাঁড়াতো। এখনকার মতো জড়ো হয়ে যেত না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর আমরা প্রদক্ষিণ করতে লাগলাম। কয়েকদিন গেছি এ রকম। আর যেদিন গুলিতে ঢাকায় বরকত, সালাম, জব্বার শহীদ হয়ে গেল, তখনতো শোক। শোকের প্রতিবাদের একটি ভাষা কালো ব্যাজ। তারা আমাদের কালো ব্যাজ লাগিয়ে দিল। আমরা আনন্দের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য কালো ব্যাজ লাগাতাম। এখন যেমন কালো ব্যাজ বুকে লাগিয়ে দেওয়া হয়, তখন হাতে লাগিয়ে দেওয়া হতো।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মাজহারুল হান্নান বলেন, একদিনের কথা খুব মনে পড়ে শহীদ হাদিসপার্কের সামনে দিয়ে আমরা হেঁটে বাজারের দিকে যাচ্ছি। থানার মোড় হয়ে বড় ভাইয়েরা স্লোগান দিচ্ছে। বেশ কিছু পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, মিট মিট করে হাসছে। তাদেরও একটা মৌন সমর্থন ছিল। কারণ তারাও তো বাঙালি। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবে এটা বলারতো অপেক্ষা রাখে না। তখনতো ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল। কাউকে বলে দিতে হয়নি। ডাক দেওয়ার সাথে সাথে দেশের মানুষ একত্রিত হয়ে গিয়েছিল। পুলিশের দিকে তাকিয়ে আমরা হাত দেখিয়ে স্লোগান দিলাম- পুলিশের জুলুম চলবে না, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। পুলিশ চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখলো। মিছিল করতে করতে আমরা সারা শহর প্রদক্ষিণ করলাম। বিএল কলেজের তৎকালীন নেতৃস্থানীয় যারা ছিলেন তারা আমাদের নিয়ে গেলেন। এরপরও কয়েকদিন সভা-সমাবেশ চলেছে। আমার ভালো লাগে যে আমরা স্লোগান দিয়ে রাষ্ট্রভাষার দাবি তুলতে পেরেছিলাম। এই অংশগ্রহণটা আজকে আমাকে খুব আনন্দ দেয় এবং উৎফুল্ল করে। আমাদের বিজয় হয়ে গেল।
তিনি বলেন, বিজয়ের পেছনের কারণ এই আন্দোলনে জনগণের সম্পৃক্ততা ছিল। যে কোনো আন্দোলন, যে কোনো বিষয়ই যদি জনগণের দাবি না হয়, জনগণ যদি এগিয়ে না আসে, তাহলে কোনো ব্যক্তি দিয়ে কিছু হয় না। এই বাংলাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সব কিছুতেই কিন্তু জনগণেরই কৃতিত্ব।
মাজহারুল হান্নান বলেন, আজকের দিনে যারা ভাষার জন্য শহীদ হয়েছিলেন আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই এবং আগামী প্রজন্ম ওই শিক্ষাকে সামনে রেখে প্রতিটি ন্যায়সঙ্গত ও সত্যিকারে যেগুলো আমাদের জন্য হওয়া উচিত সেই লড়াইয়ে যেন তারা কোনো আপস না করে। এক্ষেত্রে যেন আমরা আমাদের দেশের অস্তিত্ব, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা স্বোচ্ছার থাকতে পারি। গণতন্ত্রকে যেন কেউ নস্যাৎ করতে না পারে, স্বাধীনতাকে যাতে নস্যাৎ করতে না পারে, দেশের মধ্যে দুর্নীতি যেন কেউ করতে না পারে- একুশের চেতনা কিন্তু আমাদের তাই শিখিয়েছে।