দিঘলিয়া উপজেলার ব্রক্ষগাতী গ্রামের ৩০ বিঘা পতিত জমিতে বিনা চাষে রিলে পদ্ধতিতে সরিষা আবাদসহ মোট ৪০ হেক্টর পতিত জমিতে রিলে চাষের মধ্য দিয়ে এ উপজেলায় রিলে চাষে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
রিলে চাষ হচ্ছে যখন একটি জমিতে একটি ফসল সংগ্রহের পর পরই আরেকটি ফসলের বীজ বুনে বছরে দুই বা ততোধিক ফসল উৎপাদন করা যায়, তখন তাকে বলে পর্যায়ক্রমিক বা রিলে ফসল চাষ। দুই ফসলের জমিতে তিনটি ফসল চাষ করার অন্যতম উপায় এ রিলে পদ্ধতিতে চাষাবাদ। এ পদ্ধতিতে একটি ফসল জমিতে থাকাকালীন বিনা চাষে অন্য একটি ফসল রোপণ করা হয়। যার ফলে অর্থ ব্যয় ও পরিশ্রম অনেক কম হয়। রিলে পদ্ধতিতে যে ফসলগুলো আবাদ হয় তার মধ্যে অন্যতম হল ধানের সাথে সরিষার চাষ।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, রিলে পদ্ধতিতে চাষাবাদ এ উপজেলায় কৃষিতে নতুন সম্ভাবনার জায়গা তৈরি হয়েছে। এ পদ্ধতিতে একজন কৃষক সরিষার চাষ করে খরচ বাদে প্রতি হেক্টর জমিতে ৭০-৮০ হাজার টাকা লাভবান হতে পারবে। ৭০-৭৫ দিনের মধ্যে কৃষক তার ফসল ঘরে তুলতে পারবেন। এছাড়া আমন এবং এবং বোরো চাষের মাঝখানে যে সময়টুকু কৃষকের জমি খালি বা পতিত পড়ে থাকে সেই সময়টুকুতে অতিরিক্ত একটি ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন এবং দেশের ফসল উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে।
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মোঃ কিশোর আহমেদ খুলনা গেজেটকে বলেন, এ মৌসুমে আমন চাষ শেষ হয়ে রবি ফসলের কার্যক্রম চলছে। দিঘলিয়া উপজেলায় এ বছর ১২০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে এরমধ্যে ৪০ হেক্টর জমিতে এ বছর সর্বপ্রথম রিলে চাষের মাধ্যমে আবাদ শুরু হয়েছে। আর এ উপজেলায় রিলে পদ্ধতিতে সরিষা আবাদের মধ্য দিয়ে একটা নতুন সম্ভাবনার জায়গা তৈরি হয়েছে। আমন মৌসুমে ধান আবাদের পরে যখন জমি পতিত থাকে তখন এ সময়টা আমরা কৃষকদের রিলে পদ্ধতিতে সরিষার চাষে উদ্বুদ্ধ করেছি। রিলে চাষের মাধ্যমে কৃষকরা এখন থেকে বছরে দুইটা ফসলের পরিবর্তে তিনটা ফসল পাবে।
এই পদ্ধতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হবে। আমন মৌসুমে ৭৫ ও ৮৭ জাতের ধান যেগুলো স্বল্প জীবনকালীন সেই ধান কেটে নেওয়ার ১০ দিন আগে জমির রস বা জো থাকা অবস্থায় এ বছর কৃষকদের আমরা বিনামূল্যে বিন-৯ জাতের সরিষার বীজ দিয়েছি। সেগুলি কৃষকরা জমিতে ছিটিয়ে দেওয়ার ১০ দিন পর ধানটা কেটে নেওয়ার পর সরিষা অংকুর হয়েছে। অঙ্কুরোদগমের মাধ্যমে কৃষকরা সেই সরিষাটা বিনা চাষে পেয়ে যাচ্ছে। ৭০-৭৫ দিনের মধ্যে সরিষা উঠে যাবে। এরপর উচ্চ ফলনশীল বোরো জাত চাষ চলে আসবে। ফলে আমন এবং বোরো চাষের যে গ্যাপ পিরিয়ড, সেই গ্যাপ পিরিয়ডে কৃষক কিন্তু একটা বাড়তি ফসল পেয়ে যাচ্ছে। আমরা হিসাব করে দেখলাম ১ হেক্টর জমিতে যে সকল কৃষকরা এই রিলে চাষ পদ্ধতিতে সরিষার আবাদ করেছে তারা এক হেক্টর জমিতে খরচ খরচা বাদে ৭০-৮০ হাজার টাকা লাভ করতে পারবেন। এটা একটা দারুণ সম্ভাবনা। তিনি বলেন, এ বছর আমরা ৪০ হেক্টর জমিতে এ পদ্ধতিতে সরিষার চাষ করেছি। আমরা চেষ্টা করব আগামীতে এটা ১০০ হেক্টরের উপরে নিয়ে যেত, আমাদের যে প্রযুক্তি রিলে চাষ এটা দিঘলিয়াতে স্টাবলিশ করার জন্য।
ব্রক্ষগাতী ব্লকের কৃষক অজয় চন্দ্র দাস বলেন, আগে এই মৌসুমে আমাদের জমি ফেলানো থাকতো। কৃষি অফিস থেকে স্যাররা আসে বলল আপনারা জমি ফেলায় না রেখে সরিষার চাষ করেন। উনারা বললেন ৭০ থেকে ৭৫ দিনের মধ্যে আপনারা ফসল ঘরে তুলতে পারবেন। উনাদের কথা শুনে ব্রক্ষগাতী ব্লকে আমার ২৫ শতক জমিতে সরিষা বুনেছি। সরিষা খুব ভালো হইছে। ফুল আসে গেছে। ২০/২৫ দিন পর আমরা ফসল কাটতে পারব।
একই ব্লকের কৃষক বিজয় চন্দ্র দাস বলেন, এই পদ্ধতিতে সরিষার চাষ আমাদের মাঠে আগে কখনও হয়নি। আগে দুইট ফসল করতাম। আমন আর বোরো। এবছর কৃষি অফিসের স্যারদের কথায় আমার ৩০ শতক জমিতে সরিষা বুনেছি। কৃষি অফিস থেকে বারি-৯ জাতের সরিষার বীজ আমাদেরকে ফ্রি দিছে। সরিষা খুব ভালো হইছে। ফুল ধরেছে। কৃষি অফিসার স্যারেরা সবসময় আমাদের পরামর্শ দিচ্ছে। স্যারের কাছে দাবি থাকবে আগামী বছর যাতে আরও আগে আমাদের সরিষার বীজটা দেয়। সময় মত ফসল উঠাতে পারি যাতে বোরো চাষে আমাদের কোন অসুবিধা না হয়।
রিলে পদ্ধতিতে সরিষার চাষ করা মোঃ লিটন শেখ বলেন, উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি অফিসার কামাল স্যারের পরামর্শে আমি ৩৬ শতক জমিতে সরিষার আবাদ করেছি। আশা করি ফসল ভালো হবে। আগামী বছর অনেক কৃষক এ পদ্ধতিতে সরিষা চাষ করবে।
ব্রক্ষগাতী ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোঃ কামাল হোসেন বলেন, ইতিপূর্বে রোপা আমন এবং বোরো এই দুই ফসলের মাঝখানের সময়টা জমি ফাঁকা থাকতো, পতিত থাকত। আমি এখানকার কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে বলেছি আপনাদের জমি ফাঁকা পড়ে আছে। এই জমিতে সরিষা বুনলে ৭০ থেকে ৭৫ দিনের মধ্যে আপনারা ফসল ঘরে তুলতে পারবেন এবং অনেক লাভবান হবেন। আমার কথায় তারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রক্ষগাতী ব্লকের মাঠে কৃষকরা সরিষা আবাদ করতে সম্মত হয়। কৃষি অফিস থেকে আমরা বিনামূল্যে বিনা -৯ জাতের সরিষা বীজ সরবরাহ করি। গত মাসের ১০ তারিখে কৃষকরা জমিতে বীজ বপন করে। এখন গাছে ফুল ধরেছে। আশা করি হেক্টর প্রতি ১ দশমিক দুই মেট্রিক টন সরিষা হবে যার বাজার মূল্য সম্ভাব্য ৯৬ হাজার টাকা। বীজ বাদে কৃষকদের সেচ এবং সার খরচ হবে হেক্টর প্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। খরচ বাদে তারা হেক্টর প্রতি থেকে ৭৫-৮০ হাজার টাকা লাভবান হবে। এর মাধ্যমে যে সরিষার তেল উৎপাদন হবে সেটা আমাদের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে। আগামীতে আরো বেশি জমিতে রিলে পদ্ধতিতে চাষ করার জন্য আমরা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করব।
দিঘলিয়া ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, রিলে চাষ খুবই লাভজনক একটি পদ্ধতি। এ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে আমন এবং বোরো চাষের মাঝখানের সময়টুকু পতিত জমিতে বাড়তি একটা ফসল উৎপাদিত হয়। ব্রক্ষগাতী ব্লকে এ বছর ৪৫ জন কৃষককে উদ্বুদ্ধ করে আমরা ৫ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ করিয়েছি। বপনের ২০ দিন পর সেচ দিয়ে বিঘা প্রতি ৮ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলেই যথেষ্ট। ১০ নভেম্বর বীজ বপন করা হয়েছে। বোরো আবাদের মৌসুম শুরু হবে ২০ থেকে ২৫ জানুয়ারি। এর আগেই কৃষক রিলে চাষের মাধ্যমে আবাদকৃত সরিষা ঘরে তুলতে পারবে।
খুলনা গেজেট/এইচ/লিপু