১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজী তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে জনসম্মুখে রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেন। সারাদেশ মেতে উঠেছিলো বিজয় উল্লাসে। ঠিক ওই সময় খুলনায় ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের নেতৃত্বে ৪ সহস্রাধিক সৈন্যের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী ভয়াবহ প্রতিরোধ যুদ্ধের সম্মুখীন হয়। ‘শিরোমনি ট্যাংক যুদ্ধ’ নামের এই প্রতিরোধ যুদ্ধ ছিলো বিশ্বের সেরা কিছু ট্যাংক যুদ্ধের মধ্যে অন্যকম। এই এখনও যুদ্ধের কৌশল ভারত, পোল্যান্ডসহ ৩৫টি দেশের সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা কলেজে পড়ানো হয়।
বিভিন্ন সময় ট্যাংক যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী বীর মুক্তিযোদ্ধা স ম রেজোয়ানের স্বাক্ষাতকার, বীর মুক্তিযোদ্ধা স ম বাবর আলীর লেখা স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান গ্রন্থ, উইকিপিডিয়া এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন বই থেকে জানা গেছে, ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনিসহ খুলনার আশপাশের বিভিন্ন উপজেলা স্বাধীন করে মুক্তিযোদ্ধারা খুলনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। বিকল্প ছক কষছিলো হানাদার বাহিনীও।
১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর কমান্ডার হায়াত খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী যশোর সেনানিবাস ছেড়ে খুলনার দিকে অগ্রসর হয়। তাদের বিশাল ট্যাংক রেজিমেন্ট, পদাতিক সেনা, রাজাকার বাহিনীর বিশাল শক্তি নিয়ে খুলনার শিরোমণি এলাকায় জড়ো হয়। পরবর্তীতে খুলনার শিরোমণি, আটরা, গিলাতলা, তেলিগাতি, দৌলতপুর ও শোলগাতিয়া এলাকার একাধিক স্থানে ক্যাম্প গড়ে তোলেন। তার মধ্যে জনশূন্য শিরোমণি এলাকায় কমান্ডার হায়াত খান সবচেয়ে বড় ক্যাম্প গড়েন এবং মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করতে থাকেন।
কিছুদূর পর পর তারা বাংকার, ট্রেঞ্চ, মাইন ফিল্ড, ক্যামোফ্লোজ সব মিলিয়ে শিরোমণি দুর্ভেদ্য হয়ে ওঠে। পাকিস্তানিদের বয়ানে ট্যাংকের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া হলেও সানডে টাইমসের প্রতিবেদনে ৪০টি ট্যাংকসহ সব ভারি অস্ত্র নিয়ে খুলনার দিকে পিছু হটার কথা বলা হয়েছে। শিরোমণিতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা এবং সাংবাদিক মুসা সাদিকও ৩০-৪০টি পাক ট্যাংকের কথা বলেছেন।
শিরোমনি এই যুদ্ধ শুরু হয় ১৪ ডিসেম্বর থেকেই থেমে থেমে শুরু হয়। ১৫ ডিসেম্বর ফুলতলার চৌদ্দ মাইল ক্যাম্প থেকে মিত্রবাহিনী মেজর জেনারেল দলবীর সিং, ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুর এবং ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল যৌথ নেতৃত্বে খুলনার বিভিণ্ন এলাকায় অবস্থান নেওয়অ পাক বাহিনীকে ঘিরে ফেলা হয়। মেজর মঞ্জুর উপ-সেক্টর কমান্ডার মেজর হুদাকে সঙ্গে নিয়ে আক্রমণ-কৌশল তৈরি করেন। চক্রাখালি মাধ্যমিক স্কুল থেকে মেজর জয়নাল আবেদিনের (স্বাধীনতা পরবর্তী ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার) নেতৃত্বে গল্লামারি রেডিও সেন্টার অভিমুখে আক্রমণ শুরু হয়।
মিত্র বাহিনীর অপর একটি ইউনিট ইস্টার্ন জুট মিল গেট এলাকা দিয়ে ভৈরব নদ পার হয়ে শিরোমণির ঠিক পূর্বপাশে অবস্থান নিয়ে সেখান থেকে পশ্চিম পাশে পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশে গোলা ছুড়তে থাকেন। ওই সময় মেজর মঞ্জুর তার বাহিনীকে নিয়ে ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর দুই দিন ধরে বিভিন্ন দিক থেকে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে শিরোমণির সীমিত অবস্থানে ঘিরে ফেলেন।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণের সংবাদে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। হায়াত খান পরাজয় স্বীকার না করে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডো দলের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের নেতৃত্বাধীন সেই ট্যাংক রেজিমেন্ট এবং চার সহস্রাধিক সেনা। বিকাল থেকেই মেজর মঞ্জুরের নেতৃত্বে শুরু হয় সর্বাত্মক সম্মুখ সমর। সারারাত ধরে চলা ভয়াবহ সেই ট্যাংক যুদ্ধে স্মৃতি এখনও ভুলতে পারেনি ওই এলাকার মানুষ।
স্থানীয়রা জানান, শিরোমণি বাজার ও এর উল্টো দিকে বিসিক শিল্প নগরী ঘিরে কমবেশি চার কিলোমিটার এলাকার মধ্যে এমন কোন গাছ বা ভবন ছিল না যেটি অক্ষত ছিল। প্রতিটি গাছ ও ভবনে শত শত গুলি ও শেলের আঘাতের চিহ্ন ১৯৮০-৮১ সাল পর্যন্ত দেখা গেছে। আজও কিছু তাল গাছ এবং পুরাতন বড় গাছে সে আঘাতের সাক্ষ্য খুজেঁ পাওয়া যাবে।
যুদ্ধে প্রবল ক্ষয়ক্ষতির মুখে এক পর্যায়ে ১৭ ডিসেম্বর ভোরে পর্যুদস্ত পাকবাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় এবং শিরোমণি নসু খানের ইটভাটার কাছে মিত্রবাহিনী-মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করে।
১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর বেলা দেড়টায় সার্কিট হাউস মাঠে লিখিত আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় মিত্র বাহিনীর মেজর জেনারেল দলবীর সিং, ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুর ও ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল, পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের বেল্ট ও ব্যাজ খুলে নিয়ে আত্মসমর্পণের প্রমাণাদিতে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। আনুমানিক প্রায় ৩৭০০ জন পাক সেনা আত্মসমর্পণ করেন। এভাবেই বিজয় দিবসের একদিন পর ১৭ ডিসেম্বর স্বাধীন হয় খুলনা।
খুলনা গেজেট/ এসজেড