মহামারি করোনায় দুই বছরের মন্দাভাব ও গেল বছরের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ব্যস্ত সময় পার করছেন ফুলের রাজ্য খ্যাত যশোরের গদখালী, পানসারি ও শার্শাসহ বেশ কয়েকটি এলাকার ফুল চাষিরা।
এবছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফুল উৎপাদন ভালো হয়েছে, দামও রয়েছে বেশ। ফুল কেনাবেচা ফের চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। এ মৌসুমে যশোরের ছয় সহাস্রাধিক ফুল চাষি ৫০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে বসন্ত বরণ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে ঘিরে ফেব্রুয়ারিতে ফুল বিক্রি অন্যতম উচ্চতায় পৌঁছায় । ফুল চাষ, সংগ্রহ ও ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত এ এলাকার লক্ষাধিক মানুষের কাছে উৎসবের মাস হিসেবে পরিচিত ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে তাদের কর্মব্যস্ততা আরও বেড়েছে।
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি, পানিসারা, নাভারণ, নির্বাসখোলা শার্শা উপজেলার উলাশী এলাকায় ফুল চাষ হয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে চাষিদের পরিশ্রমে মাঠে মাঠে দোল খাচ্ছে গাঁদা, গোলাপ, জারবেরা, রজনীগন্ধাসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল।
গদখালীর ফুল বাজারে বর্তমানে প্রতিটি গোলাপ ৩-৫ টাকা, গ্লাডিওলাস কালারভেদে ৮-১৪ টাকা, জারবেরা ৬-১০ টাকা, রজনীগন্ধা ৪-৬ টাকা, চন্দ্রমল্লিকা ১.৫০- ২ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এক হাজার গাঁদা ফুল ৩৫০ থেকে ৫৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের পর চাহিদা ব্যাপক বেড়ে যায়। তখন ফুলের দর আরও বাড়বে বলে জানান ব্যবসায়িরা। বসন্ত বরণে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় হলুদ রংয়ের গ্লাডিওলাস ও গাঁদা, বিশ্ব
ভালোবাসা দিবসে গোলাপ আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে গাঁদা ফুল বেশি বিক্রি হয়। গেল বছর বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে একশ গোলাপ দুই হাজার টাকা পর্যন্তও বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে।
ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা ইউনিয়নের পানিসারা গ্রামের ফুল চাষি ইসমাঈল হোসেন বলেন, বংশপরস্পরায় দীর্ঘদিন ধরে ফুল চাষ করছি। এবছর ৫ বিঘা জমিতে চন্দ্রমল্লিকা লাগিয়েছিলাম। ৩ বিঘার ফুল বিক্রি শেষ হয়েছে। কিছুদিন পূর্বে ফুলের দাম কম থাকায় ৫০০ টাকা হাজার দরে বিক্রি হয়েছে। তবে এখন দুই টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে। এবছর চাষাবাদে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে এবং ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা বিক্রি হবে ইনশাআল্লাহ। তিনি চন্দ্র মল্লিকার রেনু চারা তৈরি ও টিউলিপ ফুলও চাষ করেন। গত বছর থেকে কৃষি অফিসের সহযোগিতায় প্রথম টিউলিপ চাষ শুরু করেন।
একই উপজেলার গদখালী ইউনিয়নের কোটুয়াপাড়া গ্রামের ফুল চাষি সাবেক ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, এবছর ফুল খুব ভালো হয়েছে। আমি আড়াই বিঘা জমিতে রজনীগন্ধা, গোলাপ ও কামিনী (পাতার জন্য) চাষ করেছি।
আশা করছি দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা বিক্রি হবে। কথা হয় ফুল চাষি শাহজাহান, রাসেল, জাহিদুলসহ আরও অনেকের সাথে। তারা বলেন, এবছর আবহাওয়া ভালো থাকায় উৎপাদন খুব ভালো হয়েছে। দামও ভালো পাচ্ছি।
গদখালী বাজারের ফুল ব্যবসায়ি নাজমুল হোসেন বলেন, বাজারে ফুলের ভালো দাম রয়েছে। এক হাজার গাঁদা ৩৫০
টাকা থেকে ৬৫০ টাকাও বিক্রি হচ্ছে। গোলাপ প্রতিটি ৩ থেকে ৫ টাকা। চাহিদা এখন কিছুটা কম থাকলেও
বসন্তবরণ ও ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের পর থেকে গোলাপ ও গাঁদা ফুলের বিক্রি প্রচুর বেড়ে যায়। তখন দাম আরও বাড়বে বলে তিনি আশা করছেন।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি ও যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপনন সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, গতবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফুল উৎপাদনে অনেক ক্ষতি হয়েছিল। এবার কৃষকরা ফুলের মূল্য ভালো পাচ্ছে। ফুলের অবস্থাও ভালো। তবে স্বাধীনতা দিবসটি রমজান মাসের মধ্যে পড়ায় মার্চের ফুল বিক্রিতে প্রভাব পড়তে পারে। রমজান মাসে ফুল বিক্রি তুলনামূলক কম হতে পারে। তারপরেও আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার ৫০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে ইনশাআল্লাহ।
তিনি আরও বলেন, দেশের বিভিন্নস্থানে এখান থেকে ফুল যাচ্ছে। দেশের ৭০ শতাংশ ফুলের চাহিদা আমাদের এলাকা থেকে পূরণ হয়। মাঝেমধ্যে বিদেশেও কিছু ফুল রপ্তানি করা হয়েছিল। নিয়মিত বিদেশে ফুল পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারলে চাষিরা বেশ উপকৃত হবে বলে বিশ্বাস তার।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, যশোর জেলায় এ বছর ৭০০ হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হয়েছে। গতবছর ৬৪০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছিল। এ বছর ৬ হাজার চাষি ফুল চাষ করেছেন। জেলার ৯৫ শতাংশ ফুল চাষ হয় ঝিকরগাছা উপজেলাতে। সেখানে এ বছর ৬৩০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ও পানসারি ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি ফুল চাষ হয়।
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ মাসুদ হোসেন পলাশ, ঝিকরগাছা উপজেলায় ৬৩০ হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হয়েছে। ফুল চাষের সাথে এ এলাকার লক্ষাধিক মানুষের জীবিকার সম্পর্ক রয়েছে। কৃষি অফিস চাষিদের সার্বিক সহযোগিতা করছেন।
যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ মঞ্জুরুল হক বলেন, গতবারের তুলনায় উৎপাদন অনেক ভালো হয়েছে। চাষিরা করোনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি এবার পুশিয়ে নিতে পারবে ইনশাআল্লাহ।
বাজারজাতকরণে অবকাঠামো করে দেয়া হয়েছে। এ বছর চাষিরা ৫০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি। তবে সারাদেশে ব্যবসায়িদের সম্পৃক্ততার কথা হিসেব করলে এর কলাব্রেশন এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
খুলনা গেজেট/ বি এম এস