অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রানিমা বেগম। সন্তানের জন্য তাঁর এ প্রতীক্ষা শেষ হয়নি। চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। সদ্যজাত শিশুটিতো মাত্র কয়েকঘন্টা মায়ের উত্তাপে ছিল। সেই সন্তান ছাড়া কিভাবে বাড়ি ফিরবে মা রানিমা। মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগের বারান্দায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নির্ঘুম রাত কেটেছে তাঁর।কিন্তু প্রায় ২৪ ঘন্টায়ও সন্ধান মেলেনি বুকের ধন! জানা যায়নি কারা বা কে কেড়ে নিল কয়েকঘন্টা বয়সী শিশুটি। কী উদ্দেশ্য তাঁদের।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গেটের জরুরী বিভাগের সামনে থেকে চুরি হয়ে যাওয়া রানিমা বেগমের সদ্যজাত সন্তানটির সন্ধান মেলেনি। তাই সন্তানকে ফিরে পাওয়ার জন্য রানিমা বেগমের আকুতি থামছে না।পরিবারের সদস্যারা কিছুতেই নিজেদের সান্তনা দিতে পারছেন না । এ ঘটনায় হাসপাতাল কতৃপক্ষ তিন সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করেছে।
রানিমা বেগমের স্বামী তোরাব আলী শেখ বলেন, তাঁরা ফকিরহাট উপজেলার পিলজঙ্গ ইউনিয়নের বাসিন্দা। স্থানীয়ভাবে মানুষের বাড়িতে কৃষি কাজ করেন তিনি। ১৬ বছর আগে তাদের বিয়ে হয়। ৩ বছরের মাথায় তাদের ঘরে সুমাইয়া নামে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। এরপর একটি পুত্র সন্তানের জন্য তাদের চলে আপ্রাণ চেষ্টা। এরই মাঝে তার স্ত্রীর ওরসে আসে একটি পুত্র সন্তান। স্ত্রীর গর্ভে ছেলে সন্তানের জন্ম হবে এ খুশিতে খোশ মেজাজে ছিলেন তিনি। গত কয়েকদিন ধরে তাদের পরিবারে আনন্দের বন্যা চলছিল। কিন্তু সেই আনন্দতো আর রইল না। বাচ্চাটাকে কে কোথায় নিয়ে গেল জানিনা। কেমন আছে তাও জানিনা।
তিনি জানান, রবিবার স্ত্রী রানিমা বেগম অসুস্থ হলে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয় স্ত্রীকে। সেখানকার চিকিৎসক জানান, গর্ভের সন্তান দুর্বল রয়েছে, তাই তাকে নিয়ে যেতে হবে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে দু’দিন বেশ কষ্টে কাটিয়েছেন তার স্ত্রী। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ি মঙ্গলবার সকাল ১০ টার দিকে একটি ভাড়া করা এ্যামুলেন্সযোগে ফকিরহাট থেকে হাসপাতালে আনা হয়। দুপুর পৌনে ২ টার দিকে হাসপাতালের লেবার ওয়ার্ডে জন্ম হয় পুত্র সন্তানের। বিকেল সাড়ে ৫ টার দিকে তাদের হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। ছাড়পত্র ও পুত্র সন্তান নিয়ে তারা হাসপতালের জরুরী বিভাগের সামনে এসে বাড়ি যাওয়ার জন্য গাড়ি ঠিক করতে থাকেন। ভাড়ার দারদাম ঠিক না হওয়ায় দু’জন চালককে বিদায় দেন তোরাব আলী শেখ। এরমধ্যে উজ্জ্বল নামের একজন চালকের সাথে তাদের কথা হয়। চালক তাদের কাছে ১ হাজার ৬০০ টাকা দাবি করলে তারা ১ হাজার ৪০০ টাকায় ফকিরহাট যেতে রাজি হয়। কিন্তু চালক প্রথমে তাদের না সম্মতি জানায়। কিছুক্ষণ পর এসে উজ্জ্বল নামের ব্যক্তি তাদের সাথে ফকিরহাট যেতে রাজি হয়। কিন্তু তাদের একটি ছোট গাড়ি দেখিয়ে মালামাল তুলতে বলেন। কিন্তু বাধ সাধে ছোট গাড়িতে ১০ জন ফকিরহাট পর্যন্ত যেতে পারবেনা। এক কথায় দু’কথায় তাদের মধ্যে বাকবিতন্ডা হয়। একপর্যায়ে চালক উজ্জ্বল গাড়ির চাবি দিয়ে শ্যালক মোস্তফাকে মাথায় আঘাত করতে থাকে। তাকে ঠেকাতে করতে শ^শুর বেলায়েত এগিয়ে গেলে তাকেও মারধর করে উজ্জ্বলসহ আরও কয়েকজন চালক। এরই মধ্যে বাচ্চাকে কোলে করে এগিয়ে আসে রানিমা বেগমের ছোটবোন সোনিয়া। বাবা, ভাই ও দুলাভাইকে মারধরের বিষয়টি দেখছিলেন। এর কিছুক্ষণ পর অজ্ঞাত পরিচয়ে এক নারী সোনিয়ার দিকে এগিয়ে আসে। তার কাছে প্রথম তিনবার ওই নারী শিশুটিকে চায় কিন্তু সে দেয়নি। পরবর্তীতে সরল বিশ^াসে ওই নারীর কাছে শিশুটি দেন সেনিয়া। এর কিছুক্ষণ পর নবজাতকটি নিয়ে ওই নারী লাপাত্তা হয়ে যান। তারপর থেকে শিশুটিকে আর কোথাও খুঁজে পাননি তারা।
তোরাব আলী শেখ ক্ষোভের সাথে বলেন, এখানে কর্তব্যরত আনসারের সামনে আমাদের মারধর করে তারা। কিন্তু তারা কোন কথা বলেনি। কি কারণে তার ওই দিন চুপ ছিল সে প্রশ্নের কোন জাবাবও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দিতে পারেনি। তাছাড়া শিশু চুরি হওয়ার পর থেকে সেখান থেকে চালক বা হামলাকারীরা মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে যায়।
হাসপাতালের পরিচালক মো: রবিউল হাসান খুলনা গেজেটকে বলেন, বাচ্চা চুরির ঘটনায় আবাসিক কর্মকর্তা সুহাস রঞ্জন হালদারকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে যদি কারও কর্তব্যে কোন গাফিলতি পাওয়া যায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শিশুটির খোঁজ নেওয়ার ব্যাপারে প্রশাসনকে সবধরণের সহযোগিতা করা হচ্ছে।
সোনাডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ মো: মমতাজুল হক বলেন, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু চুরির ঘটনায় মঙ্গলবার উদ্ধারের জন্য অভিযান চালানো হয়েছে। তাদের থানায় লিখিত অভিযোগ দিতেও বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা বিকেল পর্যন্ত থানায় আসেননি। তবে শিশুটি উদ্ধারের জন্য জোর পুলিশের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখছি।
খুলনা গেজেট/কেডি/এস জেড