পোশাকশ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবারও বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এদিন গাজীপুরে ১টি পুলিশ বক্সসহ অন্তত ১৯টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর চালানো হয়েছে পোশাক কারখানা, হাসপাতাল ও শোরুমে।
এদিকে ঢাকার মিরপুরে বিক্ষোভের সময় হামলা হয়েছে পোশাকশ্রমিকদের ওপর। সংঘর্ষ হয়েছে সাভারের আশুলিয়ায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে গাজীপুরে মোতায়েন করা হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
পোশাকশ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে মজুরি বোর্ড গঠন করেছে সরকার। এরই মধ্যে ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা মজুরি নির্ধারণের দাবিতে গতকাল অষ্টম দিনের মতো বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেন শ্রমিকেরা। আগের দিন পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় গাজীপুরের ভোগড়ায় আহত এক শ্রমিক হাসপাতালে মারা যান। একই দিন কোনাবাড়ী এলাকায় কারখানায় দেওয়া আগুনে আরেক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় গতকাল শ্রমিকদের আন্দোলন আরও সহিংস হয়ে ওঠে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকাল থেকেই গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক, সফিপুর ও চন্দ্রা এবং মহানগরীর ভোগড়া, চান্দনা চৌরাস্তাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিকেরা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ও চন্দ্রা-নবীনগর আঞ্চলিক মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করেন।
মৌচাক এলাকায় শ্রমিকেরা ধাওয়া দিলে পুলিশ পিছু হটে স্থানীয় ফাঁড়িতে গিয়ে অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা লাঠিসোঁটা নিয়ে ফাঁড়িতে হামলা চালান। পরে মিছিল নিয়ে সফিপুর বাজার এলাকায় যান। সেখানে একটি মোটরসাইকেল ও গাজীপুর জেলা ট্রাফিক পুলিশের বক্সে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পুলিশ এগিয়ে এলে তাঁদের আবার ধাওয়া দেন শ্রমিকেরা। এ সময় পুলিশ সফিপুরে তানহা হাসপাতালে অবস্থান নেয়। খবর পেয়ে শ্রমিকেরা ওই হাসপাতালে গিয়ে ভাঙচুর চালান।
পুলিশ বলেছে, চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় একটি পিকআপ ভ্যানে অগ্নিসংযোগ করেছেন শ্রমিকেরা। এ ছাড়া হরিণহাটি এলাকায় ফেব্রিকস বহনকারী একটি ট্রাকে আর পশ্চিম চন্দ্রায় একটি গাড়িতে আগুন দেন তাঁরা। পশ্চিম চন্দ্রায় ইলেকট্রনিক পণ্যের প্রতিষ্ঠান ওয়ালটনের একটি শোরুম ও একটি পিকআপেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে এর আগেই শোরুমে থাকা মালামাল পুড়ে যায়।
ফায়ার সার্ভিস ও সংশ্লিষ্ট কারখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, দুপুরে কালিয়াকৈরের পূর্ব চন্দ্রা বোর্ড মিল এলাকায় ফরটিস লিমিটেড নামের পোশাক কারখানায় ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় কারখানার সীমানায় থাকা চার-পাঁচটি মোটরসাইকেল, তিনটি প্রাইভেট কার ও একটি মাইক্রোবাসে আগুন দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর দুষ্কৃতকারীরা পাশের লিডা টেক্সটাইল লিমিটেড নামের আরেকটি কারখানায় ঢুকে কনটেইনারবাহী দুটি গাড়ি, একটি মিনিবাস ও চারটি প্রাইভেট কারে আগুন দেয়। ভাঙচুর চালায় কারখানায়।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, গাজীপুরে আট প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
অধিকাংশ কারখানা বন্ধ ঘোষণা
আট দিন ধরে শ্রমিক অসন্তোষের মুখে গতকাল থেকে গাজীপুরের অধিকাংশ কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সকালে কোনাবাড়ী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার সবচেয়ে বড় কারখানা তুসুকা গ্রুপের প্রধান ফটকে বড় একটি ব্যানার ঝুলছে। এতে লেখা, ‘অনিবার্য কারণে কারখানার সব কার্যক্রম আগামী ২ নভেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকবে’। আরও কয়েকটি কারখানায় বন্ধের নোটিশ দেখা গেছে।
গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশ-২–এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে উল্টো আমাদের ওপর হামলা হয়েছে। অনেক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।’
মিরপুরে শ্রমিকদের ওপর হামলা
রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী এলাকায় বিক্ষোভরত পোশাকশ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে মাঠে নেমেছিলেন ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা–কর্মী। তাঁদের মধ্যে আওলাদ হোসেন ওরফে লাক্কু নামের যুবলীগের এক নেতাকে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেখা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তিনি কয়েকটি গুলিও ছুড়েছেন। সকালে অ্যাপোলো নিটওয়্যার নামের একটি কারখানার সামনে এ ঘটনা ঘটে।
যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বলেন, আওলাদ তাঁদের কমিটিতে সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে আছেন।জানতে চাইলে আওলাদ কাছে দাবি করেন, সকালে পোশাককর্মীদের সঙ্গে যখন ঝামেলা হয়, তখন তিনি ঘটনাস্থলেই ছিলেন না।
এদিন মিরপুর অঞ্চলের বিভিন্ন পোশাক কারখানার বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা দিনভর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। রাত পৌনে আটটার দিকে তাঁরা সড়ক ছেড়ে যান।
এ ছাড়া আশুলিয়ায় দফায় দফায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকেরা। পুলিশ ধাওয়া দিয়ে এবং কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। দুপুরে আশুলিয়ার বেশ কয়েকটি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়।