খুলনার রূপসায় ১০টি পরিত্যক্ত ভবন সমঝোতার মাধ্যমে কিনে ওইদিনই প্রায় চারগুণ বেশি মূল্যে উন্মুক্ত নিলামে বিক্রির ঘটনা মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার পর উপজেলা ছাড়িয়ে জেলা জুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হলেও প্রশাসনের নিরবতা কাটেনি। সব কিছু জানার পরও অভিযোগ না পাওয়ার অজুহাতে রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
এদিকে বিক্রিত ভবনগুলো ভেঙে নেওয়ার ক্ষেত্রেও অনিয়মের দেখা মিলেছে। ফলে এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিক্রির পর পরিত্যক্ত ভবন অপসারণের কাজ শুরু হয়েছে। ভাঙার ক্ষেত্রে সিডিউলের বাইরের স্থাপনাও ভেঙে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বাউন্ডারী ওয়াল না থাকায় বাগমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত ভবনটির পিছনের দেওয়াল বাদে নিলামে বিক্রি করা হয়। তারপরও ভবনের পিছনের দেওয়াল ভেঙে লোহার জানালাগুলো খুলে নেয়া হয়েছে।
বাগমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনটি সরকারি নিলামে (পিছনের দেওয়াল বাদ) সাড়ে ৫৪ হাজার টাকায় নৈহাটীর আব্দুল হামিদ ভাসানী কেনেন। পরে সেটা সেলিম মোল্লা নামে এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেন।
ঐ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক অঞ্জনা দে জানান, ভবন নিলামের সময় পিছনের দেওয়াল অক্ষত রাখার কথা ছিল। তারপরও নিলাম বহির্ভূতভাবে পিছনের দেওয়াল ভেঙে লোহার জানালাগুলো নেয়া হয়েছে।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রব বলেন, বাগমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যািলয়ের পিছনের দেওয়ালটি বাউন্ডারী ওয়াল হিসেবে ব্যবহারের জন্য নিলাম বহির্ভূত রাখা হয়েছিল। এটার জানালা ভেঙে নেওয়ার বিষয়টি তিনি জানেন না। তিনি আরও বলেন, সরকারি নিয়ম যথাযথভাবে মেনে ওপেন নিলামের ব্যবস্থা করা হয়। পরে কাদের কাছে কত দিয়ে বিক্রি করা হয়েছে এ বিষয়টি আমাদের জানার কথা নয়।
আরও পড়ুন: সরকারি নিলামের পর দলীয় নিলাম, চারগুণ বেশি রেটে বিক্রি!
এদিকে, প্রতিবেদন প্রকাশের পরে এই প্রতিবেদকের কাছে দুটি ভিডিও আসে। সেখানে ইউএনও অফিসের নিলামে ক্ষমতাসীনদের সমঝোতার বিষয়টি উঠে এসেছে। সেখানে দেখা যায়, নিলাম ডাকার সময় চার/পাঁচ জনের নাম লেখানো হয়। যদিও তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যে প্রতিযোগিতার দেখা মেলেনি। ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র এক নেতার আশীর্বাদপুষ্ট ১০ নেতা প্রত্যেকে একটি করে নিলাম কিনেছেন। প্রথম নিলাম জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য আব্দুল মজিদ ফকির নেন। দর চূড়ান্ত হওয়ার পর তাকে বলতে দেখা গেছে আরও কয়েকটি দর লিখে রাখতে, পরে সমস্যা হতে পারে। ২য় নিলাম কেনেন আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি সদস্যা আওরাঙ্গজেব স্বর্ণ। তার নিলাম কেনা হয়ে গেলে কক্ষে অবস্থানরত স্থানীয় সিনিয়র এক আওয়ামী লীগ নেতা স্বর্ণকে বাইরে চলে যেতে বলতে দেখা যায়।
অপর একটি ভিডিওতে দেখা যায়, প্রশাসনের কাছ থেকে কেনার পর খোলা আকাশের নিচে উন্মুক্ত নিলাম বিক্রি করা হচ্ছে। নিলাম ক্রয় মূল্যের চেয়ে তিন/চার গুণ বেশি মূল্যে ডাক দিচ্ছে সাধারণ ক্রেতারা।
২য় নিলাম থেকে সর্বোচ্চ দাম দিয়ে ৪টি ভবন ক্রয় করা স্বল্প বাহিরদিয়ার জিয়া জানান, আমরা চাঁদপুরেরটি ১ লাখ ৮৬ হাজার, আনন্দনগরটি ১ লাখ ৯৪ হাজার, কাজদিয়া সদরেরটি ১ লাখ ৮৪ হাজার ও পাথরঘাটারটি ১ লাখ ৬৬ হাজার টাকায় ক্রয় করি। তিনি বলেন, প্রথমে সরকারি ডাক হয়। পরে দলীয় ফোরামে ডাক হয়। আর সেখান থেকে আমরা কিনি। তিনি আরও বলেন, ইউএনও অফিসে আমাদেরকে ঢুকতে দেয়নি। আমরা যারাই যেতাম দলীয় লোকের কাছে মার খেতে হত।।
সরকারি নিলাম ক্রয়কারী উপজেলা যুবলীগের এক নেতা বলেন, আমরা একটা কাজ করে ফেলেছি। অনেক সময় অনেক কিছু ছাড় দিতে হয়। আপনি সাংবাদিকতা করেন, নিউজ অবশ্যই দেয়া উচিত। তবে ভাই-ব্রাদার দেখতে হয়। এক জায়গায় বসবাস করতে হলে সব নিউজ যে দিতে হবে তা নয়।
রাজস্ব আইনজীবী মো. হানিফ হোসেন বলেন, রাজস্ব ফাঁকি একটা গুরুতর অন্যায়। রাজস্ব মূলত সাধারণ জনগণের টাকা। এজন্য এটাতে ফাঁকি দেয়া মানে শুধু সরকারকে নয়, জনগণকেই ফাঁকি দেয়া। তিনি বিষয়টি দেখার জন্যট জেলা প্রশাসক, দুদক ও সংসদ সদস্যের কাছে বিনীত অনুরোধের পাশাপাশি জনগণকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।
খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এড. সুজিত অধিকারী বলেন, দলের শৃঙ্খলা বিরোধী কোন কার্যকলাপের যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসে সেক্ষেত্রে আমি ছাড় দেইনা। দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করে কেউ দলে থাকতে পারবে না। গঠনতন্ত্র মোতাবেক ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হবে।
দলের পদধারী ব্যক্তিরাও তো এই কাজে জড়িত। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, কোন এক ব্যাক্তি বিশেষের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে দলের নাম ব্যবহার করতেছে, প্রভাবশালী ওই ব্যক্তি এগুলো করাচ্ছে বলে আমার মনে হয়। যারা কিনেছেন তারা দলের তেমন কেউ নয়। তারা ওই প্রভাবশালী ব্যক্তির পারসোনাল লোক। কিছু হয়ে থাকলে তিনিই উত্তর দিতে পারবেন। তাদের দায়ভার দল নেবে না। তিনি আরও বলেন, দলের নামে প্রভাব বিস্তারের সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ আসলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে বিষয়টি জেনেছি। ইউএনও নিলাম বিক্রি কমিটির সভাপতি। উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে তার (ইউএনও) সাথে কথা বলে কিভাবে কি করা যায় সেটা আলোচনার জন্য বলেছি। বিষয়টি তিনি দেখছেন।
প্রসঙ্গত, রূপসা উপজেলার ১০টি স্কুলের পরিত্যক্ত ১০টি ভবন ৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকায় গত ২৬ সেপ্টেম্বর ইউএনও অফিসে ওপেন নিলামে বিক্রি করা হয়। যা ওই দিনই প্রায় চার গুণ বেশি মূল্যে উন্মুক্ত ডাকের মাধ্যমে বিক্রি করে ক্ষমতাসীন দলের কিছু ব্যক্তি।