খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৪৫৮
আছে মামলা সংক্রান্ত জটিলতা

নামের ভুল, সঞ্চয়পত্রের অপেক্ষায় সাত পাটকলের ২ হাজার শ্রমিক

নিজস্ব প্রতিবেদক

খুলনার বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি পাটকলের শ্রমিক ছিলেন মন্টু মিয়া। পরিচয়পত্র জটিলতার কারণে আড়াই বছর ধরে সঞ্চয়পত্রের টাকা তুলতে পারছেন না তিনি।

মন্টু মিয়া বলেন, মিলের লেবার অফিস থেকে জানিয়েছে নামের ভুল আছে। যে কারণে সঞ্চয়পত্রের টাকা পেতে সমস্যা হচ্ছে। এ জন্য এভিডেভিড করা হয়েছে। কাগজপত্রও জমা দিয়েছি, তবে সঞ্চয়পত্রের টাকা এখনও পায়নি। আড়াই বছর হয়ে গেল, এখনও ঘুরছি। আমার ৪ ছেলে-মেয়ে। বড় ছেলেটা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করে। তার ইনকাম দিয়ে চলি। সঞ্চয়পত্র পেলে মাসে ব্যাংক থেকে কিছু টাকা পেতাম। এখন মাসের শুরুতে ঘরভাড়া দেওয়ার চিন্তা, বাজারঘাট, বিদ্যুৎ বিলসহ অনেক খরচ। মিল হঠাৎ করে বন্ধ হওয়াতে ছেলেদের উপর চাপ পড়েছে। খুব কষ্টের মধ্যে চলছি। কারও কাছে হাতও পাততে পারি না। না পারি চাইতে, না পারি কইতে।

মন্টু মিয়া খুলনার প্লাটিনাম জুট মিলের যান্ত্রিক বিভাগের শ্রমিক ছিলেন। নগরীর খালিশপুর প্লাটিনাম জুট মিলের শ্রমিক-কর্মচারী কলোনীর ২নং গেট সংলগ্ন রোডের ভাড়া বাড়িতে থাকেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, নিজের ও বাবার নামে সামান্য ভুল থাকার কারণে সঞ্চয়পত্র পাওয়া নিয়ে আজও ভুগছি। তবে নগদ ৯ লাখ টাকা পেয়েছি। আরও ৯ লাখের বেশি সঞ্চয়পত্র পাব। স্ট্রোক করেছি প্রায় এক মাস। চিকিৎসা প্রয়োজন, কিন্তু করতে পারছি না। পয়সাকড়ি লাগে। পয়সা পাইলে এখান থেকে বাসা ছেড়ে চলে যেতাম গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ কোটালীপাড়ায়।

একই মিলের শ্রমিক ইউনুস বলেন, আইডি কার্ডের সঙ্গে মিলের গেট পাসের নামের ভুল ছিল। সেই ভুলের কারণে আজও ভুগছি। মিল থেকে অবসরের অর্ধেক টাকা পেলেও বাকি অর্ধেক টাকার সঞ্চয়পত্র এখনও পাইনি। এখনও ঘুরতে হচ্ছে। কবে পাব তাও জানি না। আমার কোনো সন্তান নেই। স্বামী-স্ত্রী ভাড়া বাসা নিয়ে থাকি। দুজনই অসুস্থ। টাকাগুলো পেলে উপকার হবে।

অপর এক শ্রমিক মহিউদ্দিন বলেন, নামে ভুল ছিল। তার খেসারত এখনও দিতে হচ্ছে। মিল কর্তৃপক্ষ আমার নাম মহিউদ্দিনের পরিবর্তে মঈনউদ্দীন লিখেছে। এখন সেই ভুলে ভুগছি।

তিনি বলেন, মিল বন্ধের পর নগদ ৭ লাখ ৯৯ হাজার টাকা পেয়েছি। বাকি অর্ধেক টাকা সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে দেবে বলে জানিয়েছে মিল কর্তৃপক্ষ। তবে অনেকে সঞ্চয়পত্র বুঝে পেলেও আমি পাইনি। আমার মতো অনেকেই এই সমস্যায় পড়েছে। পিপলস পাঁচতলা কলোনীর ১নং বিল্ডিংয়ে থাকি। ২ ছেলে ও ২ মেয়ে আমার। নাতি-নাতনি আছে। এখন ছেলেদের আয়ে চলি। খুব কষ্টে আছি। টাকাটা পেলে বাঁচতাম। কখন অসুস্থ হয়ে পড়ব। এই টাকা কে তুলবে। আমাদেরই তুলতে কষ্ট হচ্ছে, ছেলেরা তুলবে কীভাবে? দ্রুত আমাদের সঞ্চয়পত্রের টাকা দেওয়া হোক।

তবে শুধু মন্টু মিয়া, ইউনুস আর মহিউদ্দিন নয়, নামের ভুলসহ নানা কারণে এখনও টাকা এবং সঞ্চয়পত্র পায়নি খুলনার রাষ্ট্রায়ত্ত ৭টি পাটকলের স্থায়ী ও বদলি শ্রমিকরা।

বিজেএমসি আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ২ জুলাই সরকার ২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের উৎপাদন বন্ধ করা হয়। এরপর শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ কার্যক্রম শুরু হয়। তবে এনআইডি কার্ডের সঙ্গে গেটপাসের নামের ভুল, মামলা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে খুলনা ও যশোর অঞ্চলের আলিম, ইস্টার্ন, স্টার, প্লাটিনাম, জেজেআই, কার্পেটিং ও ক্রিসেন্ট জুট মিলের স্থায়ী ও বদলী (অস্থায়ী) ২ হাজার ১৭ জন শ্রমিকের সঞ্চয়পত্র ও নগদ অর্থ আটকে আছে। এরমধ্যে স্থায়ী ২১৮ জন শ্রমিকের নগদ অর্থ এবং ১ হাজার ৪৬৪ জন শ্রমিকের সঞ্চয়পত্রের টাকা এখনও পরিশোধ করা হয়নি। এছাড়া টাকা পায়নি ৩৩৫ জন বদলী শ্রমিকও।

খুলনা অঞ্চলের এই সাতটি পাটকলের ১৫ হাজার ৩২ জন স্থায়ী শ্রমিকের মধ্যে ১৪ হাজার ৮১৪ জন শ্রমিককে নগদ ৭৬৫ কোটি ২ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এখনও ২১৮ জন স্থায়ী শ্রমিকের ৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। অপরদিকে ১৪ হাজার ৮৩ জন স্থায়ী শ্রমিকের মধ্যে ১২ হাজার ১১৯ জনকে ৬৭৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র প্রদান করা হয়েছে। আর বকেয়া রয়েছে ১ হাজার ৪৬৪ জন শ্রমিকের ৮১ কোটি ৯৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র।

এছাড়া পাটকলগুলোর ১৪ হাজার ২৭৬ জন বদলী শ্রমিকের মধ্যে ১৩ হাজার ৯৪১ জনকে ১০৯ কোটি ২১ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে। আর ৩৩৫ জন শ্রমিকের ১ কোটি ১০ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে।

প্লাটিনাম জুট মিলের সাবেক সভাপতি মো. খলিলুর রহমান বলেন, পাটকল বন্ধের ২ বছরের বেশি অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত সকল শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ করা হয়নি। বন্ধের ২ মাসের মধ্যে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ এবং তিন মাসের মধ্যে মিল চালুর কথা বলা হলেও তা আজও বাস্তাবায়ন হয়নি। পাটকলগুলো চালু না হওয়ায় খালিশপুর শিল্পাঞ্চলে এখন হা-হা-কার চলছে। ব্যবসা বাণিজ্য নেই। শ্রমিকরা অর্থের অভাবে খেয়ে-না খেয়ে রয়েছে। খুব কষ্টে জীবন অতিবাহিত করছে। তিনি দ্রুত সকল শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ এবং পাটকলগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চালুর দাবি জানিয়েছেন।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের স্থায়ী শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা সঞ্চয়পত্র আদায় কমিটির আহ্বায়ক শেখ মো. সাদেকুজ্জামান জানান, ২০২০ সালের ২ জুলাই রাতের অন্ধকারে পাটকল বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন বলা হয়েছিল ২ মাসের মধ্যে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হবে। ৩ মাসের মধ্যে পাটকল চালু করা হবে। আমরা ৪০-৪৩ বছর কাজ করেছি কোন সমস্যা হয়নি। প্রথম কিস্তির টাকা দিয়েছে তাতেও সমস্যা হয়নি। সঞ্চয়পত্রের সময় বলা হয়েছে নামের ভুল আছে এভিডেভিড করতে হবে। সেটা করেও জমা দিয়েছি, অথচ প্রায় দুই বছর হতে চলেছে এখনও পাওনা বুঝে পায়নি। আজকে আমরা কর্মক্ষম। আমাদের ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ দিতে পারি না। অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা খরচ দিতে পারি না। আমরা যতোদিন টাকা না পাবো রাজপথ ছাড়ব না। প্রয়োজনে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে রাজপথে নামব। এখনও হাজার হাজার শ্রমিককের পাওনা বকেয়া রয়েছে। দ্রুত এই পাওনা পরিশোধের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

বিজেএমসির খুলনা আঞ্চলিক সমন্বয়কারী মো. গোলাম রব্বানী বলেন, অধিকাংশ শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে। তবে নামের ভুল ও মামলা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে কিছুসংখ্যক শ্রমিকের সঞ্চয়পত্র দেওয়া এখনও বাকি রয়েছে। দ্রুত সমস্যার সমাধান করা হবে।

খুলনা গেজেট/এমএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!