শিশু ও নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে খুলনাসহ সারাদেশে কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সর্বস্তর থেকে প্রতিবাদে আইন সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রেখে প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে মন্ত্রীসভার বৈঠকে। শিশু ও নারী ধর্ষণ, নির্যাতন-নিপীড়ন রোধে সর্বোচ্চ শাস্তির এই বিধানকে স্বাগত জানিয়েছে আন্দোলনকারীরা। তবে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাষ্ট্রকেই রাখতে হবে, এমন মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের। ‘খুলনা গেজেট’র সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে নারী ও শিশু ধর্ষণের বিচারপ্রার্থীদের নানা সমাস্যা ও সমাধানে সুনির্দিষ্ট সুপারিশও করেছেন তারা।
সম্প্রতি সারাদেশে শিশু ও নারী ধর্ষণ, নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের ৯৫টি ট্রাইব্যুনালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে প্রায় পৌনে দুই লাখ মামলা বিচারাধীন। এরমধ্যে অন্তত ৪০ হাজার মামলা ৫ বছরেরও পুরাতন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে প্রত্যেকটি ট্রাইব্যুনালে গড়ে প্রায় এক হাজার ৭৫০টি মামলার জট রয়েছে। একজন বিচারকের পক্ষে এসব মামলায় দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা কঠিন। এতে একদিকে যেমন ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি কঠোর শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন না হওয়ায় ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ খুলনার পিপি এ্যাড. অলোকা নন্দা দাশ বলেন, পৃথক শিশু আদালত গঠন না হওয়া পর্যন্ত শিশুদের নিয়ে মামলাগুলোর বিচার কাজও একই ট্রাইব্যুনালে হচ্ছে। ফলে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তিতে বিচার ও প্রসিকিউটরদের ওপর চাপ আরও বাড়ছে। বেশকিছু মামলায় ট্রাইব্যুনালে কতিপয় অসাধু স্টাফদের সাথে যোগসাজশে আসামী পক্ষের আইনজীবীরা আদালতে সাক্ষী হাজির হতে দেন না। ফলে বাদীপক্ষের লোকজন জানতেই পারে না যে কবে মামলার সাক্ষী হবে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বাদীপক্ষের আইনজীবী আসামীপক্ষের আইনজীবীদের সাথে মিশে যান। সে ক্ষেত্রে ন্যায় বিচারের পথরুদ্ধ হয়ে যায়।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ খুলনার পাবলিক প্রসিকিউটর জেসমিন পারভীন জলি বলেন, আইনটির অনেক কিছু পরিবর্তন দরকার। যদিও আমাদের পর্ণোগ্রাফি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আছে। এরপরও পুরনো ব্রিটিশ আমলের সেই আইন ফলো করে কাজ করতে হচ্ছে। একটি আইনের প্রয়োগের ব্যাপারে তিনটি গ্রুপকে কাজ করতে হয়। প্রথম- তদন্ত, এক্ষেত্রে একজন যোগ্য ও সৎ পুলিশ অফিসার যদি স্বাধীনভাবে তদন্ত করেন এবং তাকে যদি তার ঊর্ধ্বতন অফিসার নজরদারিতে রাখেন তাহলে একটি সঠিক তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া সম্ভব। বর্তমান আধুনিক যুগে ডিএনএ টেস্ট, মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা সম্ভব। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হল- যথাক্রমে বিচারক এবং পাবলিক প্রসিকিউটর। একজন বিচারক যদি কমিটেড থাকেন এবং নারীবান্ধব হন, সেই সঙ্গে পাবলিক প্রসিকিউটর যদি তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন তাহলে বিচার সুষ্ঠু ও দ্রুত হওয়া সম্ভব। বেশিরভাগ কেস স্টাডিতে আসামীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী থাকে না, এটা বিচার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। এছাড়া মেডিকেল রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত সীন হয় না। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় বাদী হতাশ বা বায়াস্ট হয়ে যায়, এজন্য দ্রুত বিচারে সময়সীমা বেঁধে দিতে হবে। নিম্ন আদালতের রায় হওয়া পর্যন্ত জামিন একেবারেই দেয়া যাবে না।
তিনি আরও বলেন, এই তিনটি গ্রুপ ওয়ার্কের মাধ্যমেই একটি ভালো বা প্রত্যাশিত রায় পাওয়া সম্ভব। এছাড়া হাইকোর্টের নীতিমালা মনিটর করা হলে যার যতটুকু অপরাধ- সে অনুসারে শাস্তি হতে পারে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের অধিকাংশ মামলায়ই সাজা হয় না। মাত্র ৫ ভাগ মামলায় সাজা হয়ে থাকে। তাই আইন পরিবর্তনের চেয়েও সবচেয়ে বড় হল বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। আর এসব বিচারক হতে হবে নারী ও শিশুবান্ধব। একই সাথে সাক্ষী নিশ্চিত করাসহ আদালতে সবধরনের সুবিধা বাড়াতে হবে।
এ আইনবীদ আরও বললেন, বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সর্বোচ্চ ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে দাখিলের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। প্রতি কর্মদিবসে টানা বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করে মামলা নিষ্পত্তি করতে ট্রাইব্যুনালকে নির্দেশনা দেয়া আছে। ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ সম্পাদনের নির্দেশনাও আছে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন বলে মন্তব্য করলেন তিনি।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ খুলনার পিপি এ্যাড. ফরিদ আহমেদ বলেন, পরিবার ও সমাজের চাপে নারীরা ধর্ষণের কথা বলতে চান না। ধর্ষণের দায় নারীদের ওপর চাপানো হয় বলে অনেকেই নির্যাতনের শিকার হয়েও চুপ থাকেন। আবার ধর্ষণের ঘটনায় বিচার চাইতে গেলে চরম লাঞ্ছনার মুখোমুখী হতে হয়। অনেক সময় অতি আপনজনও নারীর পাশে দাঁড়ান না। মামলা পরে ধর্ষক ও ধর্ষকের পরিবারের সদস্যরা নির্লজ্জের মতো নির্যাতিতকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেয়। নগরীর টুটপাড়া ফায়ার সার্ভিস গলিতে ধর্ষণের শিকার একজন সংখ্যালঘু নারীকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য দিনে-রাতে হুমকি দিচ্ছে ধর্ষণ মামলা জামিনপ্রাপ্ত আসামী।
নারী নেত্রী এ্যাড. শামীমা সুলতানা শিলু বলেন, মামলায় ধর্ষণ প্রমাণিত হয়ে গেলেও নানা কারণে কালক্ষেপন করা হয়। যে কারণে বাদীপক্ষ হতাশ হয়ে যায়, সেই সুযোগে রেহাই পেয়ে যায় ধর্ষক। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকেই এ ধরণের অপরাধ মহামারী আকার ধারণ করেছে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মতোই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে পারলে সমাজের সামগ্রিক অপরাধ কমবে।
বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) খুলনার সভাপতি ডাঃ শেখ বাহারুল আলম বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের তদারকির অভাবে ধর্ষণের ময়না তদন্তের রিপোর্টে গরমিল হয়। ময়না তদন্তের রিপোর্ট ছাড়াও তো অপরাধী দোষী সাব্যস্ত হয়, সেক্ষেত্রে কি ন্যায্য বিচার পায় ভুক্তভোগী? আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেই বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। সত্য-ন্যায়ের পক্ষে রাষ্ট্রযন্ত্র সক্রিয় থাকলে অপরাধীরা দুর্বল হয়ে যাবে। অপরাধ প্রবণতা কমবে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী এ্যাড. মোমিনুল ইসলাম বলেন, ধর্ষক বা অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নির্যাতিত নারী বা তার পরিবারকে নিরাপত্তা দেবে কে? নিশ্চয়ই রাষ্ট্রকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে। কই রাষ্ট্র তো ধর্ষিতার বা তার পরিবারের পাশে দাড়াচ্ছে না! বরং প্রতিবাদের পথরুদ্ধ করে দিচ্ছে। দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে অপরাধ প্রবণতা কমবে। শুধু কাগজ-কলমে মৃত্যুদন্ডের বিধান সীমাবদ্ধ থাকলে সমাজ বা দেশে অপরাধ কমবে না।
খুলনা গেজেট/এআইএন