একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাতবরণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দোহা খান কাজল শুয়ে আছেন সীমান্ত নদী ইছামতির পাড়ে। সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার অন্তর্গত ইছামতি নদীর তীরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী গ্রাম টাউনশ্রীপুরের শ্যামল মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত শামসুদ্দোহা খান কাজল।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৭ জুন টাউনশ্রীপুর যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহিদ হন নাজমুল আবেদিন খোকন, শামসুদ্দোহা খান কাজল, নারায়ণ, মুজিবর রহমান ও আবুল কালাম আজাদসহ ৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এদের মধ্যে শহিদ নাজমুল আবেদিন ও মুজিবর রহমানকে ভারতের টাকীর জমিদার বাড়ির পাশে কবর দেয়া হয়েছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দোহা খান কাজলকে টাউনশ্রীপুরে ইছামতি নদীর পাড়ে কবর দেওয়া হয়। কিন্তু জাতির এই বীর সন্তানের কবর আজও অরক্ষিত। অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে কবরটি। তাঁর কবরস্থানে যাওয়ার কোন পথ নেই। এক সময় পথ থাকলেও বর্তমানে তা দখল হয়ে গেছে। টাউনশ্রীপুরে ছিল সাতক্ষীরার প্রথম পৌরসভা। এই মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছেন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি। ইতিহাস-ঐতিহ্যের পূণ্যভূমি এই টাউনশ্রীপুর।
টাউনশ্রীপুরে গেলে দেখা মেলে পুরাতন জমিদার বাড়ির ভগ্নাবশেষ। দেখা মেলে ঐতিহাসিক কেদার মাঠ। এই মাঠে ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এখানে একটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ রয়েছে। কিন্তু নেই কোন তথ্য সম্বলিত স্মৃতিফলক। দুটি ছোট্ট ফলক রয়েছে। ফলক দুটির একটিতে বানান ভুল অসম্পন্ন বাক্য লক্ষ্য করা যায়। এ থেকে খানিকটা আন্দাজ করা যায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়সারা মনোভাব। এখান থেকে সামান্য দূরেই শহিদ শামসুদ্দোহা কাজলের কবর। একেবারে ইছামতি নদীর বেড়িবাঁধের পাশে।
ধুলিহর-ব্রহ্মরাজপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ এমাদুল ইসলামের কাছে জানান, এই গ্রামের শ্যামল মাটিতে শুয়ে আছেন-একাত্তরের রণাঙ্গনে শাহাদাতবরণকারী শামসুদ্দোহা খান কাজল। বুনো গাছে ঢেকে আছে কবরটি। পাশে তাল গাছ আর নিম গাছ। লতা-পাতায় ঢেকে গেছে পাকা কবরস্থানটি। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এখানে একটি কবর আছে। সেখানে দেখা যায় ময়লা-আবর্জনার স্তুপ। অযত্ন-অবহেলায় রয়েছে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী এই মহান বীরমুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দোহা খান কাজলের কবরটি।
প্রধান শিক্ষক মোঃ এমাদুল ইসলাম আরও বলেন, শামসুদ্দোহা খান কাজল কোন সাধারণ মানুষ নন। তিনি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবনদানকারী বীরযোদ্ধা। জাতির গর্বিত সন্তান। তাঁর কবর এভাবে অযত্ন-অবহেলায় রয়েছে-এটা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়। আগামী প্রজন্ম এই বীরযোদ্ধাদের জীবন ও ত্যাগ অনুকরণ করবে। কিন্তু তাঁর কবরের পাশে গিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পথ নেই। এটা খুবই দু:খজনক।
একই কথা বলেন শিক্ষানুরাগী মোঃ আব্দুল হামিদ বাবু। তিনি বলেন, আগামী প্রজন্ম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে উঠবে কীভাবে যদি এভাবে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী ব্যক্তিদের কবর সংরক্ষণ করা না হয়।
এবিএম সিয়াম রহমান শুভ জানায়, সাতক্ষীরা শহরে শহিদ কাজল সরণি নামের একটি সড়ক আছে বলে জানি। কিন্তু সেই কাজল যে এখানে শুয়ে আছেন তা জানতাম না। সরকারের কাছে দাবি জানাই-শামসুদ্দোহা খান কাজলের কবরটি সরকারিভাবে সংরক্ষণ এবং সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য উন্মুক্ত করা হোক।
ওই এলাকার বৃদ্ধ আব্দুল ওহাবও একই দাবি জানান। স্থানীয়রা এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
শহিদ শামসুদ্দোহা খান কাজলের পিতার নাম আশরাফ উদ্দীন খান, মাতার নাম শামসুন্নাহার খানম। সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল এলাকায় বাড়ি। চার ভাই আর তিন বোনের মধ্যে শামসুদ্দোহা খান কাজল ছিলেন সবার বড়। তাঁর অন্য ভাই-বোনেরা হলেন-শামসুল আলম খান, শামসুজ্জামান খান কমল, শামসু কামাল খান কামাল, আখতারি জাহান খান চৌধুরী, শামীম আরা খান চৌধুরী ও শাহীন আরা খান।
জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে টাউনশ্রীপুর এলাকা ছিল ৯নং সেক্টরের অধীন। এটি দেবহাটা থানার অন্তর্গত ইছামতি নদীর তীরে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। এখানে ছিল একটি ই.পি.আর ক্যাম্প। দেবহাটা থানা ছিল পাকবাহিনীর ঘাঁটি। সেখান থেকে পাকসেনারা প্রতিনিয়ত এসে ওই এলাকায় স্থানীয় জনসাধারণের ওপর নানা প্রকার অত্যাচার চালাতো। ধরে নিয়ে যেত গরু, ছাগল ইত্যাদি। তাদের অত্যাচারের খবর পৌঁছে যায় ৯নং সেক্টর কমান্ডার এম এ জলিল ও সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টারের কাছে। অত:পর সিদ্ধান্ত হয় পাকসেনাদের ওই ক্যাম্প আক্রমণ করতে হবে। তাদেরকে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য ৬ জুন ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টারের নেতৃত্বে ভারতের টাকী থেকে সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল চাঁদনী রাতে ইছামতি নদী পার হয়ে আসেন। কিন্তু ওই রাতে পাকসেনাদের কোন অবস্থান না পেয়ে ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টারের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা রাতের শেষ ভাগে ইছামতির তীরবর্তী আহম্মদ মিস্ত্রীর বাড়িতে কয়েকটি কাঁচা ঘরে অবস্থান নেন।
ইতিমধ্যে পার্শ্ববর্তী মসজিদের ইমান নূর মোহাম্মদ ফজরের নামাজের আযান দিতে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জেনে ফেলে এবং তাৎক্ষণিকভাবে কোনো কারণেই হোক মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের কথা পাকবাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়। ভোর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা তখন অনেকেই ঘুমিয়ে। হঠাৎ চোখে পড়ে কয়েকজন পাকসেনা ধীরে ধীরে তাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নির্দেশ মতে তাদের ওপর গুলি ছুড়া হলো। সাথে সাথে খানসেনাদের কয়েকজন অস্ত্রসহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং অনেকে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে শুরু হয়ে যায় গোলাগুলি। একটানা আড়াই ঘন্টাব্যাপী যুদ্ধ চলে।
বিজয়ের উল্লাসে চারিদিক যখন জয়বাংলা জয়বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত, দেবহাটার গ্রামগুলো জেগে উঠেছে বিজয়ের গৌরবে, তখন রাজাকাররা গোপনে বিলের পথ ধরে কয়েকশ’ পাকসেনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে দেবহাটায়। দু’দিক ঘেরাও হয়ে ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার যুদ্ধে লিপ্ত হন। এই অসম যুদ্ধ বেশিক্ষণ চালালে নিজেদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে এই চিন্তা করে ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু হায়! রাজাকাররা ইছামতি নদীর তীরের নৌকাগুলো ডুবিয়ে দিয়ে গেছে, তখন তারা পাকবাহিনীর সাথে মুখোমুখি। যুদ্ধে লিপ্ত। কিভাবে তারা পাড়ি দেবে ইছামতি নদীর সামনে শত্রুর গুলি। তারপর ইছামতি নদীর পানির প্রচন্ড ঢেউ। টাকী ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার ও তাঁর সহযোদ্ধাদের বাঁচাবার জন্য এগিয়ে আসেন, কিন্তু পাকবাহিনীর প্রচন্ড গোলাগুলির মুখে পিছিয়ে যায়। তখন বশিরহাটের দুই বামপন্থী তরুণ বীর জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাবার জন্য দু’টি নৌকা নিয়ে ভারতীয় কূল থেকে ইছামতির ঢেউয়ের ওপর সাঁতার দিয়ে চলে আসেন। নৌকা দু’টি বাংলাদেশের তীরে ভিড়লে ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে টাকী ক্যাম্পে পৌঁছান।
৭ জুন, টাউনশ্রীপুর এই ভয়াবহ যুদ্ধে নাজমুল আবেদিন খোকন, শামসুদ্দোহা খান কাজল, নারায়ণ, মুজিবর রহমান ও আবুল কালাম আজাদসহ ৮জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ এবং এরশাদ হোসেন খান হাবলুসহ কয়েকজন গুরুতর আহত হন। মুক্তিযোদ্ধা হাবলুর শরীরে প্রায় ৩০টির মতো গুলি লাগে। উচ্চতর চিকিৎসায় তিনি জীবনে বেঁচে যান। শহিদ নাজমুল আবেদিন ও মুজিবর রহমানকে টাকীর জমিদার বাড়ির পাশে কবর দেয়া হয়েছিল। অত:পর ১৩ জুন ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা নতুন মনোবলে পুনরায় টাউনশ্রীপুর পাকঘাঁটি আক্রমণ করেন এবং ৩৫টি রাইফেল ও কিছু গোলাবারুদ দখল করে স্বঘাঁটিতে প্রত্যাবর্তন করেন।
প্রসঙ্গত: ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধে সাতক্ষীরা এলাকায় ছোট-বড় ৫০টি যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে শহিদ হন ৩৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যেসব মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়েছেন তাঁরা হলেন-শহিদ মেজর মহিদউজ্জামান (ঈদুল), শহিদ নাজমুল আবেদিন (খোকন), শহিদ শামসুদ্দোহা খান (কাজল), শহিদ সিরাজুল ইসলাম, শহিদ জাকারিয়া, শহিদ হাফিজউদ্দীন মোল্যা, শহিদ আবুবকর গাজী, শহিদ আনছার আলী গাজী, শহিদ আব্দুল আজিজ, শহিদ গোলজার সরদার, শহিদ আবুল কালাম আজাদ, শহিদ ইমাদুল হক, শহিদ মুনসুর আলী, শহিদ শেখ আব্দুল ওহাব, শহিদ শেখ রুহুল কুদ্দুস, শহিদ ছফেদ আলী, শহিদ নূর মোহাম্মদ, শহিদ সোহরাব হোসেন, শহিদ মোজাম্মেল হক, শহিদ লোকমান হোসেন, শহিদ মোজাম্মেল হক, শহিদ আবু দাউদ, শহিদ আবুল কাশেম মন্ডল, শহিদ সুশীল কুমার সরকার, শহিদ আব্দুল ওহাব মন্ডল, শহিদ হারুন অর রশিদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
খুলনা গেজেট/এনএম