গত আড়াই মাস ধরে ভারত সরকার বাংলাদেশি নাগরিকদের পর্যটন ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশে দেশটির ভিসা আবেদন কেন্দ্রগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ভিসা সেন্টারগুলো বন্ধ থাকার পর সীমিত পরিসরে কার্যক্রম শুরু হয়, তবে তা শুধু চিকিৎসার জন্য এবং জরুরি প্রয়োজন ছাড়া নয়।
কিন্তু পর্যটন ভিসা এখনো দেওয়া হচ্ছে না। কবে নাগাদ চালু হতে পারে সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু জানায়নি ভারত সরকার। ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ভারত খুব শিগগিরই বাংলাদেশিদের জন্য পর্যটন ভিসা চালু করবে না।
ভারতীয় ভিসা সেন্টারগুলো বন্ধ থাকলেও প্রতিদিন সেখানে ভিসাপ্রত্যাশীদের ভিড় বাড়তে থাকে। কবে পর্যটকদের জন্য ভিসা চালু হবে সে বিষয়ে গত আড়াইমাসে সুনির্দিষ্ট কোনো সময় উল্লেখ না করায় ভিসাপ্রত্যাশীরা অপেক্ষা করে কখন খুলবে আইভেক সেন্টারের (ইন্ডিয়ান ভিসা প্রসেসিং সেন্টার) দুয়ার। এরমধ্যে গত আড়াই মাসে পূজা ও অন্যান্য ছুটির সঙ্গে টানা চারদিন ছুটি পাওয়া গেছে। গত কয়েকবছর ধরেই দেখা গেছে, দেশে দুর্গাপূজা ও টানা ছুটিতে অনেকেই ভারতে যান। কিন্তু এবার আর তা হচ্ছে না।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশিদের জন্য পর্যটক ভিসা কবে চালুর বিষয়ে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, বাংলাদেশে যখন স্বাভাবিক কাজকর্ম করার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো হবে তখন ভারত পুরোপুরি কাজ শুরু করবে। একথা ভারতের দিক থেকে এর আগেও বলা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি আবারও উদ্বেগ তুলে ধরেন তিনি।
ভারতের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ইস্যুর কথা বলা হলেও কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, নিরাপত্তা ইস্যুটি এখানে বড় নয়। বড় কথা হলো ড. ইউনূসের সরকারের নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে শুরু থেকেই ভারতের শীতল সম্পর্ক ছিল। বাংলাদেশে তো ভারত ছাড়া অন্যান্য দূতাবাস রয়েছে। তারা কাজ করছে। তারপরও যদি ভারতীয় হাইকমিশন বা ভিসা সেন্টারের ক্ষেত্রে আরও বেশি নিরাপত্তার দরকার হয়, তাহলে সেটি নিশ্চিত করতে পারে সরকার। তারা মনে করেন, ভিসা সহজ করা দরকার।
বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমি মনে করি ভারতের পর্যটক ভিসা চালু হলে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে সহায়ক হবে।’ ভিসা বন্ধ করে দেওয়া বর্তমান সরকারের ওপর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের অংশ কি না এ প্রশ্নে হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমি এটাকে সরাসরি কূটনৈতিক চাপ মনে করি না। এটা বলা যায় যে ভারতের দিক থেকে এটা একটা বার্তা দিচ্ছে যে এখন সম্পর্কটা স্বাভাবিক নয়। তবে ভারতের দিক থেকে কখনো স্বীকার করা হয়নি যে কূটনীতিক চাপের অংশ হিসেবে ভিসা ইস্যু করা সীমিত করা হয়েছে।’
কেন ভিসার জন্য হাহাকার
ঈদ-পূজা, টানা তিনদিনের ছুটি কিংবা পরিবার নিয়ে, দলবলে ঘুরতে যাওয়ার প্রসঙ্গ এলেই সবার আগে আসে ভারতের নাম। সবসময়ই ভ্রমণে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভারতের নাম যেমন আগে আসে তেমনি বেশি পর্যটকের তালিকায়ও বাংলাদেশের নামই সবার আগে ভারতের কাছে। সাধ্যের মধ্যে সাধের জায়গায় বিদেশ ভ্রমণে প্রতিবেশী দেশ ভারতই জনপ্রিয়। সব সময়ই এই চলাচল অব্যাহত ছিল। একটা সময় ভিসাও সহজ ছিল। আর সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ পাড়া মহল্লার মতোই যাতায়াত করতো এক সময়। এখন ভিসা ছাড়া ভারত যাওয়া সম্ভব নয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এবং তার আগের সরকারগুলোর সময় থেকেই ধীরে ধীরে মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতে পর্যটন ভিসার কদর বাড়ে। একই ভাবে চিকিৎসা ভিসাও বাড়ে।
এরমধ্যে ঢাকা ছাড়াও ভারত আরও ছয়টি ভিসা সেন্টার খুলেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। বিগত সরকারের সময়ে দুই দেশের শীর্ষ পর্যায় ও কূটনৈতিক পর্যায়ের সব বৈঠকেই ভারতীয় ভিসা আরও সহজ করার বিষয়টি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রাধান্য পেত। সেই দিক থেকে ভিসা জটিলতা কমিয়ে আনতে দুই সরকার প্রধানদের মধ্যে আলোচনাও হয়েছে। সর্বশেষ গত জুনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকে অন অ্যারাইভাল ভিসার বিষয়টিও আলোচনায় আসে।
এ ব্যাপারে কূটনৈতিক বিশ্লেষক হুমায়ুন কবির বলেন, আগের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো হয়েছে। সাধ্য ও সাধ্যের মধ্যে হওয়ায় অনেকেই পরিবার নিয়ে বা একা ভারত ভ্রমণে যেতে চান। বাংলাদেশিদের ভারত ভ্রমণে যাওয়া হলো একটা ঐতিহাসিক বিষয়। এখন এর চাহিদা বেড়েছে। নানা কারণে এই চাহিদা তৈরি হয়েছে। তাই সব কিছুর পরও ভারত যাওয়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। উৎসব, পূজা, ঈদের কেনাকাটা এসবে সবাই সেখানে যেতে চায়।
প্রসঙ্গত, কোভিড মহামারির আগের বছরও ভারত বাংলাদেশে প্রায় ১৮ লাখ পর্যটন ভিসা ইস্যু করেছিল, যা একটি রেকর্ড। এই ভিসা-প্রাপকদের মধ্যে অনেকে একাধিকবার ভারতে এসেছিলেন। ফলে ধারণা করা হয়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে অন্তত ২০ থেকে ২২ লাখ বাংলাদেশি পর্যটক ভারতে গিয়েছিলেন।
খুলনা গেজেট/এইচ