শীতে খেজুরের রসের সঙ্গে গ্রাম বাংলার সম্পর্ক বেশ পুরানো ও নিবিড়। তবে এই খেজুর গাছের রসের স্বাদ ভুলতে বসেছে খুলনার তেরখাদার মানুষ। বর্তমানে গাছির সংকট; অন্যদিকে খেজুর গাছ ব্যবহার হচ্ছে ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে। এ কারণে তেরখাদা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে খেজুরের রস। বর্তমান প্রজন্ম ভুলতে বসেছে এ রসের স্বাদ।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ৯০ এর দশকের শুরু থেকে তেরখাদায় খেজুর গাছ বিলুপ্ত হওয়া শুরু হয়। ফলে খেজুর গাছ থেকে রস বের করা বেশিরভাগ গাছি গাছ কাটা মৌসুমে কাজ না পেয়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। যেসব গাছ অবশিষ্ট আছে সেগুলো এখন পড়ে রয়েছে গাছির অভাবে।
এখন আগের মতো চোখে পড়েনা সারিবদ্ধভাবে রাস্তার দুই পাশে, জমির আইলের ওপর ও বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি খেজুর গাছ। দেখা যায় না শীতের কুয়াশাভেজা সকালে যুবক, বৃদ্ধ, ছোট ছেলে মেয়েদের খেজুরের রস খেতে। পাওয়া যায় না মাটির কলস ভরা খেজুরের রসের ঘ্রাণ।
উপজেলার আজগড়া, বারাসাত, ছাগলাদাহ, সাচিয়াদাহ, তেরখাদা ও মধুপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকায় খেজুর গাছের সংখ্যা তুলনা মূলক কম। যা আছে তার বেশিরভাগ পড়ে আছে। অল্প কিছু সংখ্যক খেজুর গাছ কাটা হয়। স্থানীয় জনসাধারন ও গাছিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আজ থেকে মাত্র ৮/৯ বছর আগেও তেরখাদা উপজেলার সর্বত্র খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করা হত। সকালে মাঠে ঘাটে ভিটায় ঠিলে (কলশি) বা হাড়ি ভর্তি খেজুর রসের ছড়াছড়ি চোখে পড়ত। চারদিকে খেজুর রসের নাস্তা ও রসের পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যেত, মানুষ এখন রসের নাস্তা আর রসের ভেজা পিঠার সাধ ভুলে যেতে বসেছে। এখন আর আগের মত চারদিকে রসের সারি সারি ঠিলে চোখে পড়ে না। খেজুর গাছ চলে যাচ্ছে বিভিন্ন ইট তৈরির ভাটায়। সেখানে খেজুর গাছ পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইট। এ ছাড়া খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় এই গাছ কাটার কাজে নিয়োজিত গাছিরা চলে যাচ্ছে অন্য পেশায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই গ্রাম বাংলা থেকে হারিয়ে যাবে এই খেজুরের রস।
উপজেলা সদরের কাটেংগা জয়সেনা ও তেরখাদা হাট বাজার ঘুরে দেখা যায়, চিনি ও রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত গুড় উঠলেও তা ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। কথা হয় ইখড়ি এলাকার গাছি মিরাজ, কাটেংগার গাছি ইলিয়াছের সঙ্গে। তারা জানান, এখন এলাকায় খেজুর গাছ নেই বললেই চলে। যা দুই একটা আছে তা নিজেদের পরিবারের মানুষের জন্য কাটছি। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে যদি বেশি থাকে তা বিক্রি করি। প্রতি কলস রস ৩০০-৩৬০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
উপজেলা সদরের গাছি ফজলু মোল্যা জানান, আগে শীতকালে শত শত গাছ কেটেছি। অনেক রস পেতাম। রস বাজারে বিক্রি করতাম। রস দিয়ে গুড় বানাতাম। গুড় বাজারে বিক্রি করতাম। শীতের মৌসুমে বেশ টাকা আয় করতাম। পরিবার পরিজন নিয়ে ভালোই দিন কাটত। কিন্তু বর্তমানে এলাকায় খেজুর গাছ নেই বললেই চলে। এখন গাছ যা আছে তা মালিকেরা নিজেদের জন্য কাটাচ্ছে। ফলে এই পেশায় নিয়োজিত মানুষ দিন দিন কাজ হারাচ্ছে। তারা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। তেরখাদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, গ্রাম বাংলায় শীত মৌসুমে রস সংগ্রহের পদ্ধতিতে ব্যস্ত থাকেন গাছিরা। খেজুর রস থেকে বিভিন্ন রকমের গুড় তৈরি করে থাকেন গাছিরা। তবে দিন দিন এই শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে। এই শিল্প পুনরুদ্ধারে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।