ডায়াবেটিস হয়েছে, সেটা দীর্ঘদিন বুঝতেই পারেননি আফরোজা আক্তার। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই তিনি শুকিয়ে যাচ্ছিলেন, ক্লান্তি আর অবসাদ বোধ করছিলেন।
‘অনেক দিন ধরে শরীরে খারাপ লাগছে দেখে একজন মেডিসিনের ডক্টরের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আরও কিছু পরীক্ষানিরীক্ষার সঙ্গে ডায়াবেটিসের পরীক্ষাও দিয়েছিলেন। সেখানেই ধরা পড়ে, আমার নাকি অনেকদিন ধরেই ডায়াবেটিস হয়ে গেছে।’
তিনি বলছিলেন, এরপর ডায়াবেটিস হাসপাতালে পরীক্ষা নিরীক্ষার করিয়ে ওষুধ খাওয়া শুরু করেন।
তিনি একাই নন, ডায়াবেটিক বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে ডায়াবেটিক আক্রান্তদের ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ টের পাননা যে তারা এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
অন্য কোনো রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে গিয়ে তাদের রোগটি ধরা পড়ে।
বাংলাদেশের ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ. কে. আজাদ খান বলেন, ”ডায়াবেটিস আছে এমন রোগীদের অন্তত ৫০ শতাংশ জানেন না যে, তার ডায়াবেটিস আছে। এ কারণে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সবার সচেতনতা বৃদ্ধি খুব জরুরি।”
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট)-এর একটি জরিপে দেখা গেছে, দেশে মোট ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক কোটি ১০ লাখ। এদের মধ্যে ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের সংখ্যা ২৬ লাখ আর ৩৫ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা ৮৪ লাখ।
বাংলাদেশের ডায়াবেটিক সমিতির মহাসচিব মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন বলছেন, ‘যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকে, তারা প্রথমদিকে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন না। কারণ এটা হচ্ছে ধীরগতির ঘাতক। যার হয়েছে, সেদিনই তাকে বিপদে ফেলবে না, কিন্তু আস্তে আস্তে তার শরীরের ক্ষয় করে দেবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস অশনাক্ত থাকলে বা চিকিৎসা না হলে কিডনি, লিভার, চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই সঙ্গে শরীরের ত্বক নষ্ট হয়ে যায়, চুল পড়ে যায়। শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গও ক্ষতির শিকার হতে পারে।
সাইফুদ্দিন বলছেন, ‘যারা যত বেশি শারীরিক পরিশ্রম করবেন, প্রতিদিন যদি অন্তত ১০ হাজার কদম কেউ হাঁটেন, তাহলে ডায়াবেটিক হলেও সেটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। কিন্তু সেটা কতজন করেন?’
তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘কেউ ডায়াবেটিক হলে অবশ্যই তার জীবনযাপনে অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাইপ-২ ধরণের ডায়াবেটিসের ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই আগেভাগে সতর্ক থাকলে, শারীরিক পরিশ্রম করলে এবং খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপনে নিয়ন্ত্রণ আনলে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু একবার ডায়াবেটিস হয়ে গেলে আর এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না।
যে সব লক্ষণ দেখলে সতর্ক হতে হবে :
* ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া ও পিপাসা লাগা
* দুর্বল লাগা’ ঘোর ঘোর ভাব আসা
* ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া
* সময়মতো খাওয়া-দাওয়া না হলে রক্তের শর্করা কমে হাইপো হওয়া
* মিষ্টি জাতীয় জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যাওয়া
* কোনো কারণ ছাড়াই অনেক ওজন কমে যাওয়া
* শরীরে ক্ষত বা কাটাছেঁড়া হলেও দীর্ঘদিনেও সেটা না সারা
* চামড়ায় শুষ্ক, খসখসে ও চুলকানি ভাব
* বিরক্তি ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠা
* চোখে কম দেখতে শুরু করা
কাদের ঝুঁকি বেশি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাদের বাবা-মা, ভাই-বোন বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের এই রোগটিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে।
এছাড়া যারা নিয়মিত হাঁটাচলা বা শারীরিক পরিশ্রম করেন না, অলস বা অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেন, তাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
এছাড়া নারীদের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস রোগ হতে পারে।
যাদের হৃদরোগ রয়েছে, রক্তে কোলেস্টেরল বেশি, উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, তাদেরও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
যেসব শিশুর ওজন বেশি, যাদের বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানী বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস রয়েছে, যাদের মায়ের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হয়েছিল, সেই সব শিশুর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
কী করতে হবে?
বাংলাদেশের ডায়াবেটিক সমিতির মহাসচিব মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন বলছেন, যাদের ঝুঁকি রয়েছে, তাদের অবশ্যই বছরে একবার ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাতে হবে।
এজন্য সবসময় হাসপাতালে যেতে হবে এমন নয়। এখন অনেক ফার্মেসিতে স্বল্পমূল্যে দ্রুত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা যায়। সেখান ডায়াবেটিস শনাক্ত হলে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
যাদের শিশুর ঘনিষ্ঠ স্বজনদের ডায়াবেটিসের ইতিহাস রয়েছে, তাদেরকেও বছরে অন্তত একবার করে পরীক্ষা করাতে হবে।
সাইফুদ্দিন বলছেন, ‘ডায়াবেটিস যত তাড়াতাড়ি শনাক্ত করা যাবে, সেই রোগীর জন্য সেটা তত ভালো। তাতে তিনি যেমন রোগটির চিকিৎসা দ্রুত শুরু করতে পারবেন, পাশাপাশি তার জীবনযাপনও একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে।’
সূত্র : বিবিসি
খুলনা গেজেট/এএ