খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২১ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

ডায়াবেটিস ও ইনসুলিন

ডা. হিমেল ঘোষ

ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র হরমোন সংশ্লিষ্ট একটি অসংক্রামক দীর্ঘমেয়াদী রোগ। সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। এই রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, কিডনীর সমস্যাসহ অনেক জটিলতার সৃষ্টি হয়। আমাদের সচেতনতা, সুষম খাদ্যাভ্যাস, নিয়ন্ত্রিত জীবনধারা দিয়ে আমরা ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি।

ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি থাকে। অগ্ন্যাশয় নামক গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত ইনসুলিন হরমোন রক্তে গ্লুকোজের পরিমান নিয়ন্ত্রণ করে। এই ইনসুলিন যদি ঠিক ভাবে কাজ না করতে পারে, বা ইনসুলিন নিঃসরণ যদি কমে যায় তখন রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়।দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলতে থাকলে বহুমূত্র রোগের জন্ম হয়। বিভিন্ন ধরনের ডায়াবেটিসের মধ্যে টাইপ-১ ডায়াবেটিস শৈশবেই দেখা দেয়, অন্যদিকে টাইপ ২ ডায়াবেটিস সাধারণত ৩৫-৪০ বছরের পরে হয়।এছাড়া অনেক গর্ভবতী মায়েদের গর্ভাবস্থায়ও ডায়াবেটিস হতে পারে। যাদের পরিবারে ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন অতিরিক্ত, যারা ধূমপান করেন বা মানসিক চাপে আছের তাদের এই রোগের ঝুঁকি বেশি। এছাড়া অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ, ভাইরাসঘটিত রোগ, অগ্ন্যাশয়ে অস্ত্রোপচার প্রভৃতি কারণেও এই রোগ হতে পারে।

এই রোগের উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে ঘন ঘন প্রসাব হওয়া; বিশেষ করে রাতের বেলায় ঘুম থেকে জেগে বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, এছাড়া খুব তৃষ্ণা পাওয়া, শরীরের ওজন হ্রাস পাওয়া, কোথাও কেটে গেলে ক্ষতস্থান শুকাতে দেরি হওয়া, অল্পতেই ক্লান্তবোধ করা, সহজেই বিভিন্ন ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়া, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া এই রোগের লক্ষণ।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আমাদের তিনটা ‘D’ মেনে চলতে হবে-
১. Diet( সুষম খাদ্যাভ্যাস)
২. Discipline ( নিয়ন্ত্রিত জীবনধারা) এবং
৩. Drug( ওষুধ সেবন)

এজন্য প্রতিদিন সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন, সরল শর্করা পরিহার করে কম সরল শর্করা গ্রহণ করুন, এক বেলা ভাতের পরিবর্তে রুটি খান, পাশাপাশি আঁশযুক্ত শাক-সবজি, ফল-মূল, পরিমাণ মতো আমিষ খাবার তালিকায় রাখুন। চিনি, মিষ্টিজাতীয় খাবার, অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। প্রতিদিন দুইবেলায় অন্তত ১ ঘন্টা হাঁটার অভ্যাস করুন, যোগ-অনুশীলন বা কায়িক পরিশ্রম করুন।

ওষুধ খেলে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ বা কায়িক পরিশ্রমের দরকার নেই এটা একেবারে ভুল কথা। নিয়মিত হাঁটার ফলে ইনসুলিন নিঃসরণ বেড়ে যায় এবং রিসেপ্টরের উপরে এর কাজ করার ক্ষমতা বেড়ে যায়।পাশাপাশি শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন, ধূমপান পরিহার করুন, মানসিক চাপ থেকে নিজেকে দূরে রাখুন, রাতে সাত-আট ঘন্টা ঘুমানোর অভ্যাস করুন। যখন ডায়েট ও ডিসিপ্লিনেও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে না, তখন ওষুধ দেওয়া হয়। যেমন-টাইপ -২ ডায়াবেটিস যেখানে রক্তে ইনসুলিন আছে, কিন্তু কাজ করতে পারছে না সেখানে প্রথমে মুখে খাওয়ার ওষুধ দেওয়া হয়, এগুলো কাজ না করলে এরপর ইনসুলিন নেওয়ার প্রয়োজন হয়। এছাড়া টাইপ-১ ডায়াবেটিস, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, ডায়াবেটিস ঘটিত বিভিন্ন জটিলতায়, অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য রোগীকে ইনসুলিন ব্যবহার করতে হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিকভাবে ইনসুলিনের ব্যবহার দরকার। আমাদের দেশে চামড়ার নিচে ইনজেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন নেওয়ার পদ্ধতিই প্রচলিত। তবে উন্নত বিশ্বে ইনহেলারের মাধ্যমে ইনসুলিন নেওয়ার প্রযুক্তিও আজকাল সহজলভ্য হয়ে উঠেছে।

চামড়ার নিচে ইনসুলিন সাধারণত দুইভাবে নেওয়া হয়, যেমন- ইনসুলিন ভায়াল বা শিশি থেকে সিরিঞ্জের মাধ্যমে এবং ইনসুলিন পেন বা কলমের মতো একটি যন্ত্রের মাধ্যমে। ইনসুলিন সংরক্ষণ থেকে শুরু করে ইনজেকশন দেওয়া পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করলে রোগী ইনসুলিনের সুফল থেকে বঞ্চিত হয়। ইনসুলিন নেওয়ার পরও রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ ঠিকভাবে না হওয়ার অন্যতম কারণ এর ভুল ব্যবহার।

প্রথমত নির্ভরযোগ্য ফার্মেসি যারা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সংরক্ষণপদ্ধতি ঠিকভাবে মেনে চলে বা ওষুধের ‘কোল্ড চেইন’ বিষয়ে সচেতন, সেসব ফার্মেসি থেকে ইনসুলিন কিনবেন। কেনার সময় উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ লক্ষ করুন। মেয়াদোত্তীর্ণ বা জমে যাওয়া এবং রং বদলে যাওয়া ইনসুলিন কিনবেন না। অব্যবহৃত ইনসুলিন কলম, কার্ট্রিজ বা শিশি রেফ্রিজারেটরের সাধারণ অংশে রাখুন (ডিপ ফ্রিজে নয়)। বাড়িতে রেফ্রিজারেটর না থাকলে শিশি একটি প্লাস্টিকের ব্যাগে রেখে রাবার ব্যান্ড দিয়ে মুখ বেঁধে একটি প্রশস্ত মুখের পানি ভরা বোতল বা মাটির কলসিতে রাখুন। শিশি বা কার্ট্রিজ একবার ব্যবহার শুরু করার পর সরাসরি সূর্যের আলো পড়ে না, এমন একটি শীতল বা স্বাভাবিক তাপমাত্রার (২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে) স্থানে ইনসুলিন সংরক্ষণ করা উচিত। এ রকম তাপমাত্রায় ৩০ দিন পর্যন্ত ইনসুলিনের গুণাগুণ নষ্ট হয় না। ব্যবহার শুরু করার পর ইনসুলিন পেন সুচ লাগানো অবস্থায় কখনোই রেফ্রিজারেটরে রাখবেন না। গরমের সময়ে ব্যবহৃত শিশি রেফ্রিজারেটরে রাখলে ভালো। তবে ইনজেকশন দেওয়ার আগে তা অবশ্যই বের করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

ইনসুলিন ভায়াল বা শিশি ইনসুলিন পেনের তুলনায় আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী। তবে কলমের মতো যন্ত্রটি দিয়ে ইনসুলিন নেওয়া সহজতর ও আরামদায়ক। সামর্থ্য থাকলে সেটা ব্যবহার করাই ভালো। ভায়াল ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভায়ালের ইনসুলিনের ঘনত্ব অনুযায়ী সিরিঞ্জ নির্বাচন করুন, ১০০ আইইউ/এমএল (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট পার মিলিলিটার) ইনসুলিনের জন্য ১০০ আইইউ/এমএলের সিরিঞ্জ এবং ৪০ আইইউ/এমএল ইনসুলিনের জন্য ৪০ আইইউ/এমএলের সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হবে। সিরিঞ্জ ও পেনের সুচ বিভিন্ন মাপের পাওয়া যায়। ছোট (৪ মিলিমিটার) ও চিকন (৩২ গজ) সুচ ব্যবহারে ব্যথা কম লাগে। সিরিঞ্জ বা পেনের সুচ একবার ব্যবহারযোগ্য। তবে সাশ্রয়ের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচবার পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারেন।

চামড়ার নিচে চর্বির যে স্তর আছে, সেখানে ইনসুলিন পৌঁছাতে হবে। পেটের চামড়ার নিচে চর্বির স্তর সবচেয়ে বেশি থাকে। ইনসুলিন ইনজেকশন দেওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা এটি। নাভির দুই পাশে দুই ইঞ্চি এবং ওপরে-নিচে এক ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা বাদ দিয়ে পেটের চামড়ার যেকোনো অংশে ইনজেকশন দেওয়া যায়। এ ছাড়া দুই হাতের বাহুর বাইরের দিকের মাঝের অংশে, দুই ঊরুর সামনের এবং বাইরের দিকের মাঝের অংশে এবং দুই নিতম্বেও ইনসুলিন ইনজেকশন দেওয়া যায়। কেউ চাইলে সারা দিনের ইনজেকশন দেওয়ার জন্য একই সময়ে দুটি জায়গাও নির্বাচন করতে পারেন। তবে বারবার একস্থানে ইনজেকশন দেওয়া যাবে না। তাই যে জায়গা ইনজেকশনের জন্য নির্বাচন করবেন, সেখানে এমনভাবে ইনজেকশন দিন যাতে প্রতিটি ইনজেকশন অন্তত এক সেন্টিমিটার দূরে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট একটি চক্র অনুসরণ করে ইনজেকশনের জায়গা নির্বাচন করলে আরও ভালো। ইনজেকশন দেওয়ার জায়গা মাঝেমধ্যেই ভালো করে পরীক্ষা করে দেখুন। চামড়ার কোথাও অস্বাভাবিক মোটা বা পাতলা হয়ে গেলে, প্রদাহ বা সংক্রমণ কিংবা লাল হলে সে জায়গা পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সেখানে ইনজেকশন দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।

ধরণভেদে ইনসুলিন নেওয়ার সময়কাল ভিন্ন হতে পারে। কোনো কোনো ইনসুলিন (এনপিএইচ, গ্লারজিন, ডিগ্লুডেগ, ডিটেমির) ২৪ ঘণ্টায় একবার বা দুবার নিতে হয়, দিনে বা রাতের একটি নির্দিষ্ট সময়ে। খাওয়ার সঙ্গে এসব ইনসুলিন গ্রহণের কোনো সম্পর্ক নেই। হিউম্যান রেগুলার ইনসুলিন মূল ৩ বেলা খাবারের ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট আগে নিতে হয়। হিউম্যান প্রিমিক্সড ইনসুলিন একই নিয়মে সকাল ও রাতে খাওয়ার আগে নিতে হবে। আবার দ্রুত কার্যকরী অ্যানালগ ইনসুলিন প্রধান তিন বেলা খাবারের পাঁচ মিনিট আগে নিলেই চলে, অ্যানালগ প্রিমিক্সও একই নিয়মে নিতে হয়।

ইনসুলিন নেওয়ার আগে প্রথমেই ভালো করে হাত ধুয়ে নিন। ইনজেকশনের জায়গা পানি বা অ্যালকোহল প্যাড দিয়ে পরিষ্কার করুন এবং শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। যদি ঘোলা ইনসুলিন ব্যবহার করেন, তাহলে ভায়াল বা পেন অন্তত ২০ বার হাতের তালুতে রেখে ঘুরিয়ে বা হাতের আঙুলে ধরে ওপর-নিচ করে ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। এরপর অ্যালকোহল প্যাড দিয়ে ভায়ালের মুখ ভালোভাবে মুছে নিন। পেনের পুরোনো সুচ খুলে নতুন সুচ লাগান। যত ইউনিট ইনসুলিন দেবেন, সেই পরিমাণ বাতাস সিরিঞ্জে টানুন। এবার ভায়ালের মুখের রাবারের স্টপারে সিরিঞ্জ প্রবেশ করান এবং বাতাস ভায়ালে প্রবেশ করান। ভায়ালের মুখ নিচের দিকে রেখে প্রয়োজনমতো ইনসুলিন সিরিঞ্জে টানুন। পেন ব্যবহারের ক্ষেত্রে যত ইউনিট ইনসুলিন নেবেন, সেই পরিমাণ ডায়াল ঘুরিয়ে নিন। এবার ইনসুলিন দেওয়ার জায়গার চামড়া দুই আঙুল দিয়ে ভাঁজ করে একটু তুলে ধরুন। চামড়ার ভাঁজের চূড়ায় খাড়াভাবে সুচ প্রবেশ করান। ধীরে ধীরে ইনজেকশন দিন। কোনো কোনো পেন ডিভাইসে একবার চাপ দিলেই ইনজেকশন–প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে যায়। ইনজেকশন দেওয়া শেষ হলে সিরিঞ্জ ও পেনের নির্দেশক শূন্যতে চলে আসবে। ইনজেকশন দেওয়া হয়ে গেলে সিরিঞ্জ বা পেনের সুচ সঙ্গে সঙ্গে বের করে ফেলবেন না। সুচ ভেতরে রেখে মনে মনে ১০ পর্যন্ত গণনা করুন। এবার সুচ খাড়াভাবেই চামড়া থেকে বের করুন এবং চামড়ার ভাঁজটি ছেড়ে দিন।

ব্যবহৃত সুচ যত্রতত্র না ফেলে নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ করুন এবং তা নিয়মানুযায়ী নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন। মনে রাখবেন যে ইনসুলিন নেওয়ার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অবশ্যই নির্ধারিত বেলার খাবার খেয়ে নিতেই হবে। ডায়াবেটিসজনিত জটিলতায় বহু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে প্রতিদিন। আসুন আমরা সুষম খাদ্যাভ্যাস করি, নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনধারার মাধ্যমে ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখি।

খুলনা গেজেট/কেএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!