সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়নের গ্রাহকের প্রায় ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকের দুইটি শাখাসহ চারটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান মহিবউল্লাহ মিন্টু আত্মগোপন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে করে বিপাকে পড়েছেন ডাচ বাংলা এজেন্ট ব্যাংকসহ তার অধীনে পরিচালিত চারটি প্রতিষ্ঠানের কর্মরত ৪০ জন কর্মীসহ কয়েক হাজার গ্রাহক। প্রতারণার ফাঁদে পড়ে কয়েক কোটি টাকা হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ গ্রাহকরা স্থানীয় কর্মকর্তাদের বাড়িতে হানা দিতে শুরু করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আশাশুনি উপজেলার হিজলিয়া গ্রামের মহিব উল্লাহ মিন্টু ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম প্রগতি ফাউন্ডেশন নামে একটি এনজিও সংস্থা খুলে শ্রীঊলা ইউনিয়নে কার্যক্রম শুরু করেন। পরবর্তীতে ‘মিন্টু টেলিকম’ নামে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এজেন্ট ব্যাংকিং শাখা শুরু করেন মিন্টু। পরে ২০১৯ সালের ২২ ডিসেম্বর ব্যাংক উদ্বোধন করা হয়। পরবর্তীতে আরেকটি এজেন্ট ব্যাংকের শাখা তৈরি করলেও ব্যাংকটির সকল কার্যক্রম চলতো নাকতাড়াস্থ এজেন্ট ব্যাংকিং হতে।
এসকল প্রতিষ্ঠানগুলোতে অফিস কর্মচারীসহ বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক মাঠকর্মী নিয়োগের মাধ্যমে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আদলে ৬ বছরে দ্বিগুণ ও দশ বছরে তিনগুণ মুনাফা দেয়ার ঘোষণা দিয়ে মেয়াদি আমানত (এফডিআর), মাসিক আমানত (এমএসএস) এবং ক্ষুদ্র পরিসরে ঋণ বিতরণ কর্মসূচির কাজ শুরু করেন মিন্টু। ২০১৩ সাল থেকে প্রথমে প্রগতি ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু করে আমানত গ্রহণ ও ঋণদান কর্মসূচি শুরু করলেও সময়ের পরিক্রমায় ডাচ ব্যাংলা এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে থাকে মিন্টু।
বর্তমানে মিন্টুর এজেন্ট ব্যাংক দু’টিতে গ্রাহক সংখ্যা রয়েছে কয়েক হাজার। এছাড়া এ পর্যন্ত ৩৯ জন ব্যক্তি বিভিন্ন মেয়াদে স্থায়ী আমানত হিসাবে ২৯ লাখ ৭২ হাজার টাকা জমা করেছেন। সর্বশেষ চলতি বছরের প্রথম দিকে প্রগতি ফাউন্ডেশনের নামে কোটি টাকার প্রজেক্টে নয়জন কর্মী নিয়োগের কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে মাথাপিছু এক লাখ টাকা করে গ্রহণ করেন মিন্টু।
এছাড়াও ডাচ্ বাংলা ব্যাংক নাকতাড়াস্থ ও তালা বাজার এজেন্ট ব্যাংকিং শাখায় নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে টেইলার পদে মমতাজ বেগমের থেকে সাড়ে ৭ লাখ টাকা, রোজিনা আক্তারের থেকে ১ লাখ, ম্যানেজার পদে সুকান্ত মন্ডলের থেকে ৩ লাখ, বিপুল সানার ৫ লাখ টাকা, ওআরও পদে শিউলি মন্ডলের কাছ থেকে ২ লাখ, মারুফুল ইসলামের ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা, পিয়ন পদে প্রশান্ত কুমার সানা ও আলামিন হোসেনকে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে মোটা অংকের টাকা জামানত হিসেবে সংগ্রহ করে মহিবউল্লাহ মিন্টু।
প্রতিষ্ঠানের প্রধান মহিবউল্লাহ মিন্টু আত্মগোপনে থাকায় শ্রীউলা ইউনিয়নের নাকতাড়াস্থ ডাচ বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং শাখার এফডিআর গ্রাহকসহ প্রগতি ফাউন্ডেশন ও প্রগতি প্রজেক্টের কয়েক হাজার গ্রাহক তাদের আমানত ও সঞ্চয়ের ৩ কোটিরও বেশি টাকা নিয়ে শংকিত হয়ে পড়েছেন।
শহিদুল্লাহ্ নামে এক ভুক্তভোগী গ্রাহক জানান, লাভের আশায় তার সঞ্চিত অর্থ গচ্ছিত রেখেছিল ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং শাখায়। মাসিক ১৫০০ টাকা লাভ দেওয়ার কথা বলে মিন্টু তার থেকে দুই দফায় ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা গ্রহণ করে। টাকার গ্যারান্টি স্বরূপ মহিবউল্লাহর স্বাক্ষরিত কয়েকটি সাদা চেকও দেওয়া হয় তাকে। চেক থাকলেও অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত তিনি।
আমিনুর নামের এক গ্রাহক জানান, দীর্ঘ সময় ধরে মহিবউল্লাহ মিন্টু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ার মধ্য দিয়ে কার্যক্রম ও স্থানীয় কর্মী নিয়োগ এবং উচ্চ মুনাফা দিয়ে প্রগতি ফাউন্ডেশন, ডাচ্ বাংলা এজেন্ট ব্যাংকিং শাখাসহ মোট চারটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে এলাকার মানুষের ভরসা অর্জন করে। এভাবে স্থানীয় কর্মীদের উপর আস্থা, অন্যদিকে নামডাক দুই-ই মিলে গ্রাহকদের বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হয় প্রতারক মিন্টু। বাজারের ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় মূলধনের বিনিয়োগের পাশাপাশি তার প্রতিষ্ঠানগুলোতে লাখ লাখ টাকা গচ্ছিত রাখে। এলাকার ছোট ছোট দোকানদার, ব্যবসায়ী, ভ্যান-চালক, কুলি-মজুরীসহ নিম্ন আয়ের লোকজন তাদের সকল গচ্ছিত ও সঞ্চয়কৃত টাকার নিরাপদ স্থান হিসাবে এখানে বিনিয়োগ করে। এখন এসব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার মহিবউল্লাহর প্রতারণার ফাদে পড়ে নিঃস্ব হতে চলেছে গ্রাহকরা।
এ ব্যাপারে ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের নাকতাড়াস্থ এজেন্ট ব্যাংকের টেইলার মমতাজ বেগমসহ অন্যরা জানান, সাতক্ষীরা থেকে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এসএসএম, এবি মোঃ মোরশেদ আলম গত ১৬ আগস্ট ব্যাংকে এসেছিলেন এবং তিনি এফডিআর বাবদ নগদ টাকা নিয়ে গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে জমা না করার কারণে ৩ দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা দিতে সতর্কীকরণ নোটিশ দিয়ে যান মহিবউল্লাহকে। তবে মহিবউল্লাহ’র অনুপস্থিতে নোটিশটি মমতাজ বেগম গ্রহণ করেন। মিন্টু পলাতক থাকায় ব্যাংক বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে এজেন্ট ব্যাংকের তদারকিতে থাকা ব্যাংকটির এবি মোরশেদ আলম (এসএসএম) জানান, আমি ব্যাংকটি ভিজিট করে সকল ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন করেছি। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ ও মোবাইলে অনেকের সাথে কথা বলেছি। অনিয়ম ধরা পড়ার পর মিন্টুকে নোটিশ পাঠিয়েছিলাম এবং কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না সেটার জন্য তিন কার্য দিবসের ভিতরে জানানোর কথা উল্লেখ করেছি। তবে মিন্টু পলাতক থাকাই নোটিশটা মমতাজ বেগমের জিম্মায় ছিলো। সে নোটিশটা মিন্টুকে পাঠিয়েছে বলে শুনেছি। পরবর্তীতে কী হয়েছে সেটা সম্পর্ক অজ্ঞাত জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ব্যাংক ব্যতিত অন্য প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিতে মিন্টু ব্যাংককে ব্যবহার করার চেষ্টা করে অনৈতিক কিছু করে থাকলে তার দায় তাকেই নিতে হবে। এজন্য ব্যাংকের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।
এ বিষয়ে আশাশুনি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গোলাম কবির বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছু দিন আগে জেনেছি। তবে এখনও কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্ত পূর্বক অভিযুক্ত মহিবউল্লাহ মিন্টুর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
খুলনা গেজেট/এনএম