সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা খুলনার কয়রা উপজেলার শেওড়া গ্রামস্থ কপোতাক্ষ নদের চরে প্রায় দু’কোটি টাকায় নির্মিত গুচ্ছগ্রাম প্রতিনিয়ত জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। বর্ষাকালের শুরু থেকেই টানা তিন মাস গোনের জোয়ারের পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে আঙ্গিনার বালু ও কাঁচা ঘরের ভিটের মাটি।
এছাড়া সেখানে যাতায়াতে সু-ব্যবস্থা নেই, সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই, নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। ফলে চরম মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে ঘর পেয়ে খুশিতে আপ্লুত হওয়া বাসিন্দাদের। নাগরিক সুবিধা না থাকায় ইতোমধ্যে ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে দুই-তৃতীয়াংশ উপকারভোগী।
প্রকল্পটির কাজ নিয়ে শুরু থেকেই নানা অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি, অনিয়ম ও নদীর চরে অপরিকল্পিতভাবে গুচ্ছগ্রামটি গড়ে তোলায় সরকারের ভাল একটি উদ্যোগে সফলতা আসেনি বলে মনে করেন সচেতন নাগরিক সমাজ।
সরেজমিনে দেখা যায়, কপোতাক্ষ নদের চরে গড়ে তোলা ৬০টি জরাজীর্ণ বাসগৃহ ও সুন্দর একটি অফিস কক্ষ রয়েছে। চারটি অগভীর নলর্কপের সবগুলোই নষ্ট। বৈদ্যুতিক পিলার ও তার থাকলেও নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। চরম লাজুক অবস্থায় রয়েছে নদীর পানি রক্ষার তিন পাশের বাঁধ। বাঁধের উত্তর ও পশ্চিম পাশের বেশ বড় দুটি ভাঙন দিয়ে ভিতরে পানি ঢুকছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পানিতে তলিয়ে যেতে দেখা যায় গুচ্ছগ্রামের তিনটি পুকুর, চলাচলের রাস্তা ও আঙ্গিনা। উল্লেখযোগ্য কোন বাঁধ না থাকায় জোয়ারের পানি বৃদ্ধি হলেই এমনিভাবে তলিয়ে যায় বলে সেখানকার বাসিন্দারা জানান।
তারা আরও জানান, ঘরের মেঝে (ভিট) মাটি দিয়ে তৈরি হওয়ায় নদীর পানিতে ধ্বসে যায়। বারবার মেরামত করেও ভালো রাখা যায় না। ঘরগুলো দুর্বল হওয়ায় সামান্য ঝড় হলেই পড়তে হয় চরম ঝুঁকিতে। আত্নকর্মসংস্থানের সুযোগ থাকলেও চরম ঝুঁকির মধ্যে কাজে লাগাতে পারছেন না তারা। একদিকে বালু দিয়ে ঘরের আঙ্গিনা ভরাট করার ফলে ও মিঠা পানির সংকটে গাছ কিংবা সবজি চাষ ভালো হয় না। যা হয় সেটাও নোনা পানিতে ডুবে মারা যায়। বাঁধ ঝুকিপূর্ণ হওয়ায় হাঁস-মুরগীর ফার্ম কিংবা ছাগল-গরু পালন করে আত্মকর্মসংস্থানেরও সু-ব্যবস্থা নেই তাদের। এছাড়া তিনটি পুকুরে মাছ চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও বাঁধের কারণে কাজে আসছে না।
তারা বলেন, দীর্ঘদিনের এসব সমস্যা সমাধানে দাবি করে আসলেও অদ্যবধি কেউ কোন ব্যবস্হা নেয়নি। এমনকি বর্তমান চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত চোখের দেখা দেখতেও আমাদের এখানে আসেন নি। সরকারি-বেসরকারি তেমন কোন সহযোগিতাও আমরা পাইনা। শুনেছি এনজিও সংস্থা অসহায়দের জীবনমান উন্নয়নে অনেক কিছু করে, তবে আমাদের এখানে কেন করে না, আমরা কি দোষ করলাম? দুঃখভরাক্রান্ত মনে এমন প্রশ্নও রাখেন তারা।
এসময় রিক্তাদাস, জামিলা, জাকারিয়াসহ বেশ কয়েকজন বসবাসকারী জানান, দীর্ঘদিন জোয়ারের পানি ওঠানামা করায় মাঠের বালু ধুয়ে নদীতে চলে যাচ্ছে। চৈত্র মাসের শেষের দিক থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি জোয়ারে ঘরের আঙ্গিনায়, এমনকি মেঝেতে পানি ওঠে।
কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, গুচ্ছগ্রামের রাস্তা বাদেও প্রধান সড়ক ভালো না হওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে চরম ভোগান্তীতে পড়তে হয় তাদের। এছাড়া বিদ্যুৎ না থাকায় কেউ ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়ালেখা করেন, আবার কেউ সোলারের আলোতে পড়াশুনা করেন।
এর আগে ৩ মার্চ সরেজমিন পরিদর্শনকালে কথা হয় গুচ্ছগ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়া রঞ্জিতা দাস, রেবেকা, শাহজাহান মোড়ল, রেজাউল, সবুর মোড়লসহ কয়েকজনের সাথে। তারা বলেন, আশ্রয় পেয়ে খুশি মনে আমরা এখানে এসেছিলাম। তবে থাকার পরিবেশ না থাকায় চলে গেছি। যেখানে এখন রয়েছি সেখানেও খুব কষ্টে ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছি।
গুচ্ছগ্রামস্থ উপকারভোগীদের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের বসবাসের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৬০ টি ঘরের ব্যবস্হা করায় আমরা খুব খুশি। তবে কিছু সমস্যায় আমাদের মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে। নদীর পানি রক্ষায় মাত্র ৩/৪ শ’ মিটার টেকসই বাঁধ নির্মাণ ও ঘরের মেঝেগুলো পাঁকা করার ব্যবস্থা করতে পারলে আমরা শান্তিতে বসবাস করতে পারতাম। এছাড়া সুপেয় পানি, বিদ্যুৎ ও পুকুরের পাড় বাধার ব্যবস্থা করতে পারলে আমাদের ভোগান্তি কমার পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে পারতাম। এ বিষয়গুলো সমাধানে সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ করছি।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে আশ্রয়ণ প্রকল্প -২ এর আওতায় ৬০টি ঘর নির্মাণের জন্য ৯০ লাখ, ৪টি নলকূপ স্হাপনের জন্য ৩ লাখ ২০ হাজার, কমিউনিটি ভবন তৈরীর জন্য ৭ লাখ ৯৩ হাজার টাকা এবং আশ্রয়ণ প্রকল্পের জায়গা ভরাটের জন্য ২৫১.৪০১ মেট্রিকটন চাউল বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে তৎকালীন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (বর্তমানে মোংলায় কর্মরত) মো: জাফর রানার কাছে বরাদ্দের পরেও সুপেয় পানির জন্য ডিপ টিউবওয়েলের ব্যবস্থা না করে স্যালো (অগভীর নলকূপ) বসানোর বিষয়ে জানতে চাইলে সদুত্তোর মেলেনি। এছাড়া নদীর চরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার বিষয়ে তিনি বলেন, নদীর তীরে পাইলিংয়ের মাধ্যমে বাঁধের ব্যবস্থা করতে পারলে জোয়ারের পানি আসতো না। তবে পাইলিংয়ের বরাদ্দ না পাওয়ায় আমরা কাজ করতে পারিনি। তিনি আরও বলেন, পুকুর সংরক্ষণের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার ইচ্ছা থাকার পরেও অন্যত্র চলে আসায় সেটার ব্যবস্থা করতে পারিনি।
আরও পড়ুন: কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত কয়রার শ্যাওড়াপাড়া গুচ্ছগ্রাম ছাড়ছে অধিবাসীরা (ভিডিও)
বাগালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ গাজী বলেন, ওখানে ৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পের একটি বরাদ্দের জন্য আবেদন করা হয়েছে। আশা করছি আগামী এক/দেড় মাসের মধ্যে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার পরে আর কোন অতিরিক্ত বরাদ্দ পাওয়া যায় না। আমরা তিনবার আবেদন করার পরেও বলা হয়েছে নতুন কোন বরাদ্দ দেয়া হবে না। এজন্য আমাদেরকে স্থানীয়ভাবে টিআর/কাবিখা থেকে সংস্কার কাজ করতে হয়। যা দিয়ে টেকসই বাঁধ নির্মাণ অসম্ভব। এছাড়া গুচ্ছগ্রামগুলো ভেড়িবাঁধের বাইরে হওয়ায় সিকিউর না। একবার বাঁধ সংস্কারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, নদীর তীর হওয়ায় ফের ভেঙে গেছে। ইউপি চেয়ারম্যানের মাধ্যমে দ্রুত সংস্কারের আশ্বাস দেন তিনি।
উল্লেখ্য, উপজেলায় ৬টি গুচ্ছগ্রাম রয়েছে। নদীর চরে স্থাপিত হওয়ায় একটু ঝড়-বৃষ্টিতে অধিকাংশ স্থানেই ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয় বসবাসকারীদের। তাছাড়া প্রায় সবগুলোতে কমবেশি সমস্যা রয়েছে।
খুলনা গেজেট /টআই/এমএম