খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ কার্তিক, ১৪৩১ | ২২ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  নাটোরে সড়ক দুর্ঘটনায় মানসিক ভারসাম্যহীন অজ্ঞাত ব্যক্তি নিহত
  সাবেক এমপি ব্যারিস্টার সুমন গ্রেপ্তার

জীবনযুদ্ধে হার না মানা নাছিমা খাতুন

এমএম আসিফ

সেই ছোট্ট বেলায় বাবাকে হারাতে হয়েছে। তখন বয়স মাত্র ৭ বছর। জোটেনি বাবার আদর-সোহাগ। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে পরিবার। ছয় বোন আর দুই ভাইকে নিয়ে গৃহিনী মা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। পরিবারে নেমে আসে ভয়াবহ সংকট। সংসারের হালধরার মতো কেউ ছিল না। সেইমুহুর্তে আট ভাইবোনের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া খুব কষ্টের ছিল। খুব কষ্টের মধ্যে লেখাপড়া করতে হয়েছে। এসএসসি পাশ করার পর দেখা দেয় নতুন প্রতিবন্ধকতা। খুব ইচ্ছে ছিল খুলনা সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হবো। কিন্তু আত্মীয়-স্বজনরা তাতে অস্বীকৃতি জানায়। মেয়ে হয়ে এতো লেখাপড়া কেন করতে হবে আর করলেও স্থানীয় কলেজে না পড়ে শহরে যেতে হবে। সেই প্রতিবন্ধকতা কাটাতে বেগ পোহাতে হয়েছে। বড় ভাইকে ইচ্ছে আর স্বপ্নে কথা জানালে তিনি খুলনা সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। এরপর কষ্ট করে প্রতিদিন নদী পার হয়ে লেখাপড়ার জন্য শহরে আসতাম। অনেক বাধা বিপক্তি কাটিয়ে লেখাপড়া করতাম। কষ্ট হলেও হাল ছাড়িনি। ছোট থেকেই মেধাতালিকায় ভালো ফলাফল ছিল। তাই লেখপড়ার প্রতি ইচ্ছে শক্তিটাও ছিল প্রকট।

জীবনযুদ্ধে সংগ্রামের কথা এ প্রতিবেদকের কাছে উপস্থাপন করেন রূপসা উপজেলার নৈহাটী ইউনিয়নের কিসমত খুলনার শ্রীরামপুরের মোসা: নাছিমা খাতুন। তিনি এখন খুলনা সরকারি মহিলা কলেজের প্রভাষক পদে কর্মরত আছেন।

তিনি বলেন, স্বপ্ন ছিল লেখাপড়ায় বহুদূর যাবো। বিসিএস শেষ না করে বিয়ের কোন পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু লেখাপড়া চলাকালীন সময়ে ছোট দুই বোনের বিয়ে হয়ে যায়। তখনই শুরু হয় সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে অথচ বড় বোনের বিয়ে হয় না এমন অনেক কটূকথা শুনতে হতো। কতো কটূক্তি সহ্য করেছি। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষিকা পদে যোগদান করি। সেখানে দিনে শিক্ষকতার আর রাতে লেখাপড়া করেছি। নিজ লক্ষ্যে অটুট ছিলাম। অবশেষে ২৯ তম বিসিএস এর ভাইভা পরীক্ষা দিয়ে ১৫তম মেধাক্রমে উত্তীর্ণ হয়েছি।

তিনি নৈহাটী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা এবং নৈহাটী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এছাড়া খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি, সরকারি বিএল কলেজ থেকে প্রাণিবিদ্যায় বিএসসি (সম্মান) এবং এমএসসি পাশ করেছেন। তিনি প্রথমে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা পদে যোগদান করেন। সেখানে তিনি আট বছর শিক্ষকতা করেছেন। বেতনের অর্থদিয়ে বইপত্র কিনে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছেন। দিনে শিক্ষকতায় সময় দিতেন আর রাতে লেখাপড়া করতেন। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে ২৯ তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে যোগদান করেন। পরে সরকারি এমএম কলেজ যশোরে এবং বর্তমানে খুলনা মহিলা কলেজে প্রাণীবিদ্যা বিভাগে প্রভাষক পদে কর্মরত আছেন। বর্তমানে তিনি এক কন্যা সন্তানের জননী। তার স্বামী এজেডএম ফয়জুল বারী একজন ব্যাংকার।

তিনি ২০১৮ সালের ৮ মার্চ জাতীয় পর্যায়ে জয়িতা পুরস্কার নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে।

এই সংগ্রামী নারী বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করাকালীন সময়েও অনেকের কটূক্তি সহ্য করতে হয়েছে। কেন আরও লেখাপড়া করতে হবে। একটি চাকরি আছে, তবুও কিসের জন্য দৌড়ায় ? মেয়েদের চাকরি করার দরকার কি ? এমন অনেক কথা শুনতে হয়েছে। অনেক ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু কখনো ইচ্ছাশক্তি দমেনি। নিজ লক্ষ্যে অটূট ছিলাম।

তিনি বলেন, আমি নারী সমাজের জন্য কিছু করতে চাই। সেই সাথে আমার স্বপ্ন ডক্টরেট ডিগ্রি করার। আমি সর্বদা আমার ছাত্রীদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ ও সচেতন করি। তাদের বলি লেখাপড়ার পাশাপাশি হাতের কাজ শিখতে। স্বাবলম্বি গতে হবে। সমাজে সমালোচকের অভাব নেই। সকল প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে নিজ লক্ষ্যে অটূট থাকতে হবে। অধ্যাবসায়ী হতে হবে। স্বপ্নপূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। তাহলেই সফলতা হাতছানি দিবে।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!