খুলনা, বাংলাদেশ | ২১ মাঘ, ১৪৩১ | ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত ইসলামকে ধানমণ্ডি থেকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি
  বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের লকার খোলার অনুমতি পেল দুদক

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের গৌরবগাঁথা বিদ্যাপীঠ খুলনা আলিয়া কামিল মাদ্রাসা

কাজী মোতাহার রহমান

ঊনসত্তর ও নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষী তখনকার খুলনা আলিয়া মাদ্রাসা। এ বিদ্যাপীঠের আজকের নাম খুলনা আলিয়া কামিল মাদ্রাসা। ঊনসত্তরে হাদিসুর রহমান, আলতাফ হোসেন ও প্রদীপ মিস্ত্রি শহীদ হয় এ মাদ্রাসার অদূরে হাজী মহসিন রোডে। দিনটি ঊনসত্তরের ২১ ফ্রেব্রুয়ারি। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে রিকশাচালক মহারাজ সরদার শহীদ হয়। মাদ্রাসার বিপরীতে বাগান বাড়িতে বিডিআর’র গুলিতে। দিনটি ১৯৯০ সালের ৩০ নভেম্বর। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে এ বিদ্যাপীঠের ছাত্র-শিক্ষকরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নিয়ে এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। দক্ষিণ জনপদে কোটা বিরোধী আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনে প্রতিষ্ঠানটি ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে।

এবারের আন্দোলনে ছাত্র-শিক্ষকের অংশগ্রহণ প্রশংসার দাবিদার। খুবি, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা মেডিকেল কলেজ, নদার্ন ইউনিভার্সিটি, বিএল কলেজ, সরকারি সুন্দরবন কলেজ, সরকারি পাইওনিয়ার মহিলা মহাবিদ্যালয়, খুলনা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়, সরকারি কমার্স কলেজ ও সরকারি ইকবাল নগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে। দুর্নীতি ও অপশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ কেবল রাজনীতিকদের নয়, ছাত্র-শিক্ষকদের ভেতর তৈরি হয় পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর হতাশা। অধিকার আদায়ের সচেতন ছাত্র সমাজ এক সময় স্বৈরশাসন আর কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে থাকে। সর্বশেষ ৫ আগষ্টের স্বৈরশাসনের অবসানের পর ছাত্র-শিক্ষকরা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পায়। জুলাই-আগষ্টের গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে বড় অর্জন মানুষে মানুষে সংহতি বোধ। ছাত্র সমাজ অজেয় এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়। এ সফলতা যতটা না সরকার পরিবর্তন করে দেখিয়েছে, তার চেয়ে বেশি পুরো রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার বৈকল্যকে তুলে ধরেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু দেশে ছাত্র বিক্ষোভে রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তন আসে। যার সর্বশেষ উদাহরণ আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে।

চব্বিশের ১ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়াতের পাবলিক স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা জাতি বিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। ১৯৭৬ সালের জোহানেসবার্গে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী এক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার উলওর্থ লাঞ্চ কাউন্টারে সাদা কালো ভেদাভেদের প্রতিবাদে কালো বর্ণের ছাত্ররা অবস্থান ধর্মঘট শুরু করে। এ আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লাঞ্চ কাউন্টারগুলোতে বর্ণ বৈষম্য রহিত করা হয়।

বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে অসামঞ্জস্যপূর্ণ অধিকারসহ গঠিত দুর্নীতির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আয়-ব্যয়ের বিপুল ব্যবধান তৈরি হয়। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার করা নিয়ে আন্দোলন শুরু হলেও এক পর্যায়ে নির্মমভাবে আন্দোলন দমনের প্রতিক্রিয়ায় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।

ছাত্র আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় একটি দিন ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ দু’হাত প্রশস্ত করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আচমকা একটা গুলি এই সাহসী শিক্ষার্থীর বুক ভেদ করে। তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। চব্বিশের শহীদ আবু সাঈদ, ঊনসত্তরের শহীদ আসাদ ও নব্বইয়ের শহীদ ডা: মিলনের প্রতিচ্ছবি। কোটা বিরোধী আন্দোলনে প্রথম শহীদের খবর ইথারে ইথারে সবার কাছে পৌঁছে যায়। খুলনার শিববাড়ী ও জিরো পয়েন্ট মোড়ে আন্দোলনের শ্লোগান তোলে ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাইকে ফিরিয়ে দে’।

এ শ্লোগানের শব্দ পৌঁছে যায় খুলনা আলিয়া কামিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কাছে। তারা ৩১ জুলাই মার্চ ফর জাষ্টিস, ১ আগষ্ট দোহযাত্রাসহ নানা কর্মসূচিতে সাড়া দেয়। অংশ নেয় গল্লামারী, শিববাড়ী, সাচিবুনিয়া ও জিরো পয়েন্টের কর্মসূচিতে। সামিল হয় পথযাত্রায়। সংহতি প্রকাশ ও স্ব-শরীরে অংশ নেয় জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেয়া কর্মসূচিতে।নানা মাধ্যম দিয়ে হুমকি ধামকি আসে। এক পর্যায়ে এখানকার একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। মূলত এখানে ছাত্র রাজনীতির সুযোগ ছিল না। ২০১২ সাল থেকে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু হয়। গত এক যুগ সময়ে এ রাজনৈতির সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা হচ্ছেন মিজানুর রহমান, আলী আজম, রফিকুল ইসলাম, হাফিজুর রহমান, বাহার, কামিল বিভাগের আবু নাইম, নুর আলম, মানিক প্রমূখ।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাডেমি কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়। প্রতিদিনের কর্মসূচি ম্যাসেনজার গ্রুপের মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছে যেত। নতুন নতুন শ্লোগান শুনে তাদের মধ্যে উৎসাহ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে ৩ আগষ্ট থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে ছাত্র জনতার ব্যাপক সম্পৃক্ততা বাড়ে। শিক্ষার্থীরা সরকারকে খাজনা ট্যাক্স না দেওয়া এবং সরকারি আইন অমান্য করার জন্য নগরবাসীর প্রতি আহবান জানান। একাত্তরের ন্যায় নগরবাসী এ আহবানে সাড়া দেয়। জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ৫ আগষ্ট পর্যন্ত এ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সাহসী ভূমিকা পালন করে। ইতিপূর্বে এমনটা দেখা যায়নি। শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর প্রচার হবার পর বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা অধ্যক্ষের বাসভবন ঘেরাও করে। মাদ্রাসার অফিস কক্ষে একাধিক চেয়ার, দুটি ল্যাপটপ, ওয়াইফাই লুট হয়। অফিস কক্ষ ভাঙচুর হয়। তৎকালীন শাসকদলের পক্ষ নেওয়ায় মোহাদ্দেস শিক্ষক মাওলানা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক খান আনোয়ার হোসেন এবং মোহাদ্দেস এর অপর এক শিক্ষক মাওলানা সমসের আলীকে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হতে হয়। আওয়ামী লীগ জামানার অবসানের পর অধ্যক্ষ মাওলানা যাকারিয়া মাদ্রাসা ত্যাগ করেন। পরিচালনা পরিষদ ১৯ আগষ্ট তাকে অপসারণ করে। অর্থ আত্মসাৎ সহ তার বিরুদ্ধে ১৫ টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়।

কোটা বিরোধী আন্দোলন তীব্রতর করতে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সংগঠক সম্মান চতুর্থ বর্ষের শিবলুর রহমান উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনিসহ ফাজিল প্রথম বর্ষের আই এ আরাফাত, কামিল ২য় বর্ষের আবু লাইজ, কামিল ফিকাহ ২য় বর্ষের গাজী আরাফাত, ফাজিল তৃতীয় বর্ষের হুসাইন আলী, ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তৎকালীন সময়ের শাসক দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগ কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের মাদ্রাসার বাহিরে যেতে বাধ্য করে। কোটা বিরোধী ও সরকার পতনের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত অনন্য শিক্ষার্থীরা হচ্ছেন মাহফুজুর রহমান, আবু তালহা, আব্দুল ওহাব, নাজমুস সায়াদাত, মারফ মোল্লা, আম্মার হোসাইন, আল আমিন রায়হান, হাফেজ নাজমুস সাকিব, রেদওয়ান মোল্লা, জান্নাতুল নাঈম, আরমান রাফিদ, আব্দুর রহমান, ওজিয়ার রহমান, ওবায়দুর রহমান প্রমুখ।

আন্দোলনের পক্ষের শিক্ষকরা হলেন: ফিকাহ শাস্ত্রের ড: মোহাম্মদ আব্দুর রহিম (ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ) ফিকাহ শাস্ত্রের হাফেজ মোহাম্মদ ইমরান উল্লাহ, আদিব শিক্ষক ড: মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম, আরবি বিষয় সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ জাফর উল্লাহ, অর্থনীতি বিষয় সহকারী অধ্যাপক এস এম গোলজার হোসেন, একই বিষয় প্রভাষক রাইহানা, গণিত বিভাগের প্রভাষক ফাতেমা জান্নাত, প্রদর্শক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন, লাইব্রেরিয়ান মোহাম্মদ রুহুল আমিন, সহকারী মৌলভী মোহাম্মদ নিজাম উদ্দীন, কৃষি শিক্ষা সহকারী শিক্ষক ইদ্রিস আলী, কম্পিউটার বিভাগের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ মাছুদুর রহমান, গণিতের সহকারী শিক্ষক গাজী মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, বাংলা বিভাগের সহকারী শিক্ষক মফিজুল ইসলাম, সহকারী মৌলভী মোস্তফা কামাল মাহমুদ, শারীরিক শিক্ষা বিভাগের সহকারী শিক্ষক মুহাম্মদ আবু ঈসা, দাখিল ক্বারী হাফেজ মোহাম্মদ আব্দুস সোবহান, আল কোরআন বিভাগের খন্ডকালীন প্রভাষক সাঈদ আহমেদ, মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির ও মোহাম্মদ নুরুল্লাহ।

বিপক্ষের শিক্ষকের হচ্ছেন: তৎকালীন অধ্যক্ষ মাওলানা আবুল খায়ের মোহাম্মদ যাকারিয়া, মুফাসসির বিভাগের মোহাম্মদ মাহবুবুল ইসলাম, মুহাদ্দিস বিভাগের শমশের আলী, মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, আদিব বিভাগের মুহাম্মদ মানজুরুর রহমান, রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ ইমরান হোসেন, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ খান আনোয়ার হোসেন, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ, বাংলা প্রভাষক মোহাম্মদ আতাউর রহমান, আরবী প্রভাষক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম এবং ফাজিল স্নাতক শ্রেণির আল হাদিসের খণ্ডকালীন প্রভাষক মোহাম্মদ সিরাজুজ্জামান।

খুলনা গেজেট/এম মিলন




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!