পনেরো বছরের বিধ্বস্ত অর্থনীতি জেলাবাসীকে পঙ্গু করে দিয়েছে। এ থেকে কাটিয়ে উঠতে মরণপণ চেষ্টা চলছে। দিন মজুরের মাস জুড়ে কাজ নেই। ঘাট ও বাজার শ্রমিকরা নিত্য দিন বেকার। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের অভাব ঘুচছে না। কৃষি পণ্যের চড়া দামের বড় অংশ যাচ্ছে মধ্যস্বত্ব ভোগীর পেটে। নতুন সরকারের বয়স ষাট দিন। দিন বদল ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলেও খুলনার অর্থনীতির চাকা সচল হয়নি।
৫ আগস্টে সুচনা হয় একটি নতুন বাংলাদেশ। নতুন সুর্যোদয়ের পর সবক্ষেত্রে পরিবর্তনের হাওয়া লাগলেও অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসেনি । সেই আগের অবস্থা । পাটকল রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ খুলনার বন্ধ মিল চালু করার দাবি করেছে । তারা ইতিবাচক সাড়া পায়নি । বেকার শ্রমিকরা আশায় বুক বেঁধে আছে । কাঁচা পাটের চড়া দামের কারণে বেসরকারী পাটকল গুলো হিমশিম খাচ্ছে। তোষা জাতের পাটের মন তিন হাজার দুই শ থেকে তিন হাজার পাঁচ শ টাকা। গেল বছর দাম ছিল এক হাজার আট শ থেকে দুই হাজার ছয় শ টাকা । কাঁচা পাট রপ্তানিকারকদের কাছে মজুদ নেই । ফলে দৌলতপুরের দশ হাজার বেলিং শ্রমিক বেকার। নদ নদীতে ইলিশ ধরা বন্ধ । ফলে জেলার চার হাজার জেলে সরকারি স¦ল্প চাল পেয়ে খুশি হতে পারেনি।নির্মাণ সামাগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির কারণে রাজ মিস্ত্রি ও জোগালদের মাস জুড়ে কাজ নেই ।কার্তিক মাস থেকে ইটের ভাটার কাজ শুরু হবে ।বর্ষা মৌসুমের চার মাস ভাটা শ্রমিকরা ছিল বেকার । জেলায় তাদের সংখ্যা প্রায় চল্লিশ হাজার। ভাটা মালিকের কাছ থেকে দাদন নিয়ে তাদের সংসার চলছে। ফুটপাতের হকারদের বিকিকিনির পরিমান কম। জ্বালানি তেল পেট্রোল প্রতি লিটার ১২৭ টাকার পরিবর্তে ১২১ টাকা ও ডিজেল ১০৬ টাকার পরিবর্তে ১০৫ টাকা সরকারি মূল্য নিধারণ হলেও যানবহনের ভাড়া কমেনি ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সুত্র বলেছে,এবারের বর্ষা মৌসুমে জুলাই মাসের গড় বৃষ্টিপাতরে পরিমান ৩০৯ মি.মি, আগস্ট মাসে ৫০২ মি.মি ও সেপ্টেম্বর মাসে ৩৪৫ মি.মি। অবিবৃষ্টিতে শীতের সবজি বাজারে আসতে বিলম্ব হবে। জলাবদ্ধতায় কারণে কাঁচা মরিচ ও গ্রীষ্মের শাক সবজি মারা গেছে। বাজারে কাঁচা মরিচ কেজি ৩শ ৫০ টাকা, পুইশাক ৫০ , ঢেঁড়স ৬০ এবং আলু ৫৫ থেকে ৬০ টাকা , বেগুন ৬০ টাকা ,মিষ্টিকুমড়া ৬০ টাকা, পেঁয়াজ দেশী ১২০ টাকা ,আমদানীকৃত পেঁয়াজ ১ শ টাকা , ডিমের হালি ৫২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পনেরো দিন আগে ডিমের হালি ছিল ৫০ টাকা । ডিম আমদানির খবরে মূল্য কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে । যশরের তাহসিন ট্রেডার্স ১ কোটি ও সাতক্ষীরার সুমন ট্রেডাস ২০ লাখ ডিম আমদানির অনুমতি পেয়েছে। আমদানি প্রসঙ্গে এনবিআরের কাছে পাঠানো চিঠিতে ট্যারিফ কমিশন বলেছে, সম্প্রতি স্থানীয় বাজারে ডিমের সরবরাহে ঘাটতির কারণে এর দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ডিমের এমন অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে পণ্যটি আমদানিতে সাময়িক সময়ের জন্য শুল্ক–কর প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। বর্তমানে ডিম আমাদানিতে মোট ৩৩ শতাংশ শুল্ক কর রয়েছে ,তা অব্যাহত থাকলে স্থানীয় বাজারে দামের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব পড়বে না ।
ট্যারিফ কমিশন জানায়, সম্প্রতি বাজারে ডিম ছাড়াও পেঁয়াজ, আলুসহ বেশ কিছু অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম বাড়েছে। এ অবস্থায় গত ২১ আগস্ট পেঁয়াজ, আলু ও ডিম আমদানিতে শুল্ক-কর কমানোর বিষয়ে এনবিআরকে একটি প্রতিবেদন পাঠায় ট্যারিফ কমিশন। প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী গত ৪ সেপ্টেম্বর আলু ও পেঁয়াজ আমদানিতে শুল্ক কমায় এনবিআর। এর ফলে স্থানীয় বাজারে এ দুটো পণ্যের দাম কিছুটা কমে স্থিতিশীল পর্যায়ে এসেছে।
খাদ্য মূল্যস্থীতি সাধারণ মানুষের সহনীয় মাত্রার বাইরে বিরাজ করছে। মূল্যস্থীতি নিয়ন্তনে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি । খুলনায় বিনিয়োগের নতুন পরিবেশ আসেনি।যে কারণে নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না।স্থানীয় আমদানীকারকরা শতভাগ মার্জিনের শর্তে প্রতিবেশি দেশ থেকে আলু,পেঁয়াজ,ডিম,কাঁচা মরিচ আমদানি করেছে । রিজার্ভের ধারাবাহিক পতনের মধ্যে কেন্দীয় ব্যাংক এর মাধ্যমে ডলার বিক্রি চালু করেছে ।গত সপ্তাহে ডলারের মূল্য ছিল ১১০ টাকা ,বুধবারের মূল্য ১১৯ দশমিক ৭৮ টাকা । শারদীয় দূর্গোৎসব উপলক্ষে শপিং কমপ্লেক্সগুলোতে দিন রাত বিকিকিনি চলছে। একই সাথে নারিকেলের,গুড়, বাতসা ও বাতাবি লেবুর চাহিদা বেড়েছে । স্থানীয় ৪ নং ঘাট থেকে বেনাপোল স্থল বন্দর দিয়ে ১৮ টন ইলিশের প্রথম চালান রপ্তানি হয়েছে । প্রতি কেজির রপ্তানি মূল্য ১০ ডলার ।
ব্যাংক খাত সংষ্কারে টাস্ক ফোর্স গঠনসহ নানা উদ্যোগ খুব বেশি না হলে অর্থনীতি স্থিতিশীলতায় কিছুটা স্বস্তি আসবে । বাজার পরিস্থিতি এবং সরবারহ তদারকীতে আগামী সপ্তাহে স্থানীয় বাজার গুলোতে বিশেষ টাস ফোর্স পরিচালনা করা হবে । ১০ সদস্যর এই টাস্ক ফোর্সে ২ জন ছাত্র প্রতিনিধি থাকবে ।
মোংলা বন্দরে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮২৭ টি জাহাজ এসেছিল, অপরদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৪৬ টি জাহাজ এসেছে । গত বছরের তুলনায় এ বছরে মোট ১৯ টি জাহাজ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে জাহাজ আগমনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৪০ টি । লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৬ টি জাহাজ বেশি এসেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯৯.০৫ লক্ষ মেট্রিক টন কার্গো হ্যান্ডলিং করা হয়েছিল। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ বন্দরে ১০৮.৬৮ লক্ষ মেট্রিক টন কার্গো হ্যান্ডলিং করা হয়েছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দক্ষিণাঞ্চল থেকে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি হয় ৫ হাজার ৪৮২ মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য ৭৪৯ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে একই সময় চিংড়ি রপ্তানি হয় ৪ হাজার ৩৯৮ মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য ৫৬৫ কোটি টাকা।গত তিন মাসে আগের অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১৮৪ কোটি টাকা বেশি।
বিদ্যমান অর্থনীতি প্রসঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের খুলনা নগর সভাপতি মো : বিল্লাল হোসেন বলেন, ব্যবসায়ীদের হাতে নগদ টাকার পরিমান কম । তিনি বলেন ,অর্থনীতি খুব দূর্বল । ব্যবসা ক্ষেত্র সম্মানজনক নয় ।
খুলনা জেলা ইমাম পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক অধ্যক্ষ মাওলানা নাজমুস সউদ বলেন ,ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি , দালালী ও সি-িকেটমুক্ত পরিবেশ চেয়েছিলাম । কিন্তু সেটি না হওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবন যাপন দূর্বিসহ হয়ে পড়েছে ।
সাংবাদিক আন্দোলনের সংগঠক কৌশিক দে বাপীর অভিমত, এখানে বিনিয়োগ কম । সরকারি ও বেসরকারি অধিকাংশ পাটকল বন্ধ । বিনিয়োগ বাড়াতে হবে । কাজের ক্ষেত্র বাড়াতে হবে । অর্থনৈতিক প্রবাহ বাড়াতে হবে ।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক শাহিন সিরাজের অভিমত ৫আগষ্টের পূর্বের অর্থনীতি আর আজকের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল । আগে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ছিল না ।এখন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে । নতুন বাংলাদেশে আশা করা যাচ্ছে উন্নত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হবে ।
অপর এক সংগঠক মো: আলভী শেখ বলেছেন ,খুলনার অর্থনীতি ছিল কালো চাদরে মোড়া , এখনও তাই । কোন পরিবর্তন দেখি না ।
খুলনা গেজেট/কেডি