খুলনা, বাংলাদেশ | ৯ কার্তিক, ১৪৩১ | ২৫ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে আরও ৪ জনের মৃত্যু, নতুন শনাক্ত ১১২৯
  সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ বছর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সিন্ধান্ত
  তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরাতে তিন রিভিউ আবেদনের শুনানি ১৭ নভেম্বর

খুলনায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ‘ধানের গোলা’

তুহিন আহমেদ

আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে নিত্যনতুন আবিষ্কারের ফলে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে। আধুনিক বিজ্ঞানের কলা কৌশলের নিকট মার খেয়ে আস্তে আস্তে বিলুপ্তির পথে হাটছে গ্রামীন বাংলার প্রচীন ঐতিহ্যগুলো। যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন মানুষের জীবনে এটে সেটে বসছে আধুনিকতার ছোঁয়া।

হাজার বছরের চলে আসা বাঙ্গালিদের কিছু ঐতিহ্যবাহী জিনিস রয়েছে যা আমরা সেই প্রাচীন কাল হতে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে আসছি। যেগুলো বাংলার সংস্কৃতির এক একটি উপাদান ও বাঙ্গালী সংস্কৃতির ঐতিহ্যর ধারক বাহক। যা এক সময় গ্রাম বাংলার গৃহস্থের সচ্ছলতা ও সুখ সমৃদ্ধির প্রতিক হিসাবে প্রচলিত ছিল। আগেকার দিনে গ্রামবাংলায় নামকরা গেরস্থ বলতে ফসল ভরা ক্ষেত, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ আর কৃষকের গোলা ভরা ধান কথাগুলো এখন প্রবাদ বাক্যে পরিণত হতে চলেছে। খুলনার গ্রাম বাংলার সমৃদ্ধির প্রতীক ধানের গোলা আজ প্রায় বিলুপ্ত প্রায়।

হারিয়ে যাচ্ছে কৃষিক্ষেত ও কৃষকের ঐতিহ্যবাহী ধানের গোলা। মাঠ ভরা ধান ক্ষেত থাকলেও অধিকাংশ কৃষকের বাড়িতে নেই ধান মজুদ করে রাখার বাঁশ বেত ও কাদা-মাটি দিয়ে তৈরি গোলাঘর। কিন্তু এক সময় সমাজের নেতৃত্ব নির্ভর করত কার কয়টি ধানের গোলা আছে সেই হিসেব কষে।

গ্রাম অঞ্চলে বাড়িতে বাড়িতে বাঁশ, বাঁশের বাতা ও কঞ্চি দিয়ে প্রথমে গোল আকৃতির কাঠামো তৈরি করা হত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আয়তক্ষেত্র আকারেও গোলা তৈরি করা হত। এর পর তার গায়ে ভিতরে ও বাহিরে বেশ পুরু মাটির আস্থরণ লাগানো হত। এর মুখ বা প্রবেশ পথ রাখা হত বেশ উপরে যেন চোর/ডাকাতরা ধান চুরি করতে না পারে। গোলার মাথায় থাকত বাঁশ ও খড়ের তৈরি বা টিনের তৈরী ছাউনি। এসব ধানের গোলায় ১০০ থেকে ২০০ মণ ধান সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। খুলনার আড়ংঘাটা ও ডুমুরিয়া উপজেলার কয়েকটি গ্রামে এখনও চোখে পড়ে এসব ধানের গোলা।

এক সময় গোলা নির্মাণ করার জন্য বিভিন্ন এলাকায় আগে দক্ষ শ্রমিক ছিল। এখন আর দেশের বিভিন্ন জেলা শহর থেকে আসা গোলা নির্মাণ শ্রমিকদের দেখা মেলে না। পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন। গোলা নির্মাণের জন্য তাদের সংবাদ দিয়ে আনতে হত। একেকটা গোলা নির্মাণ খরচ পড়ত তার আকার ও শ্রমিক কত লাগবে তার উপর নির্ভর করে।

আড়ংঘাটা থানার রংপুর উইনিয়নের কাটাখালি এলাকার বাসিন্দা মুকুন্দ বৈরাগী (৭০) বলেন, ‘আগেকার দিনে একেকটা গোলা নির্মাণ করতে আমাদের খরচ পড়ত সেই সময়কার ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। তৈরীকৃত সেই সুদৃশ্য গোলা ছিল গ্রামের সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারের ঐতিহ্য। সে সময় ভাদ্র মাসে কাঁদা পানিতে ধান শুকাতে না পেরে কৃষকরা ভেজা আউশ ধান রেখে দিতো গোলা ভর্তি করে। গোলায় শুকানো ভেজা ধানের চাল হত শক্ত। কিন্তু ইদানিং মানুষের সংখ্যা বাড়ছে তাই জমির পরিমানও কমছে , তাই গোলায় তোলার মত ধান আর তাদের থাকছে না , যার কারনে গোলার পরিবর্তে গ্রামের কৃষকরা ধান রাখা শুরু করে বাঁশের তৈরী ক্ষুদ্রাকৃতি ডোলায়।’

তিনি আরো বলেন, ধান আবাদের উপকরণ কিনতেই কৃষকের বিস্তর টাকা ফুরায়। কৃষকের ধানের গোলা ও ডোলা এখন শহরের বিত্তশালীদের গুদাম ঘরে পরিণত হয়েছে। কৃষকের ধান চলে যাচ্ছে একশ্রেণীর অসাধু মুনাফালোভী ফড়িয়া ও আড়ত ব্যবসায়ীর দখলে। ইট বালু সিমেন্ট দিয়ে পাকা ইমারত গুদাম ঘরে মজুদ করে রাখা হচ্ছে হাজার হাজার টন ধান চাল। অনেক ক্ষুদ্র কৃষক বস্তা ও ব্যারেল ভর্তি করে রাখছে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধান চাল।

আগে যারা গ্রামের জমিদার ছিল তাদের গোলাভরা ধান ও পুকুর ভরা মাছ ছিল জমিদারি প্রথা ও উচ্চ চাষী পরিবারের ঐতিহ্য। পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া গোলাঘরে ধান চাল ওঠানো-নামানো হতো গরুর গাড়িতে করে। তবে গ্রাম এলাকায় এখনো বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী গোলা রক্ষায় ধনী শ্রেণীর কৃষকরা বাঁশের তৈরি গোলা ধরে রেখেছেন। বাস্থবতা বড়ই নিষ্ঠুর। আগামী প্রজন্মের কাছে গোলা ঘর একটি স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। আধুনিক গুদাম ঘর ধানচাল রাখার জায়গা দখল করছে। ফলে গোলা ঘরের ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে।

গুটুদিয়া ইউনিয়নের খামারবাটি গ্রামের বাসিন্দা অসবরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক ভোলানাথ মন্ডল (৬৫) বলেন, বর্তমানে বিজ্ঞানের আধুনিক সৃষ্টির ছোঁয়াতে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ধানের গোলা বিলুপ্তির পথে। ধানেরগোলার মতো অনেক বাঙালি ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এস সকল ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।

তিনি আরো বলেন, গ্রাম বাংলার এ প্রাচীন ঐতিহ্য ধানের গোলা সংরক্ষণ করতে হবে। না হলে এ ঐতিহ্যময়ী ধানেরগোলা স্থান নেবে জাদুঘরে কিংবা পাঠ্যপুস্তকের পাতায়। সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের নতুন প্রজন্মকে ধানেরগোলা দেখতে লোকশিল্প জাদুঘরে যেতে হবে কৃত্রিমভাবে সাজানো ধানের গোলা দেখার জন্য।

খুলনা গেজেট/ এস আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!