ইটভাটা নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ম, পরিবেশ আইন বা ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন যে কোনো কাজে আসছে না, তা বোঝা গেল ভদ্রা নদীতে ইটভাটা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে। ইটভাটার থাবা থেকে নদীও এখন বাঁচতে পারছে না।
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ভদ্রা, হরি ও ঘ্যাংরাইল নদী, রূপসার আঠারোবেকী নদী, বটিয়াঘাটার কাজিবাছা নদী, পাইকগাছার শিপসা নদী, কয়রার কপোতাক্ষ নদীসহ বিভিন্ন নদীর পাড়ে ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে। এসব ভাটা মালিকরা প্রতি বছর নদীর বুক দখল করে ভাটার বিস্তৃতি বাড়াচ্ছে।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, কেবি ব্রিকস নামের একটি ইটভাটা ভদ্রা নদীর সীমানা নির্ধারণকারী পিলার থেকে আরও ভেতরে ইট-সুরকি ও বালু দিয়ে নদী ভরাট করে ইটভাটা বানিয়েছে। ভাটায় শুধু কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানোর নিয়ম থাকলেও এখানে গাছের গুঁড়ি ও কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় মালিকদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহস পায় না।
‘কেবি ব্রিকসের’ মতো ভদ্রা ও হরি নদীর চার কিলোমিটারের মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় ১৮টি ইটভাটা। ইটভাটার মালিকেরা জায়গা দখল করায় নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। কোথাও কোথাও নদী প্রায় মরে গেছে। এতে ভাঙনের হুমকির মুখে পড়েছে সেতু ও বাজার। ভাটাগুলোই অধিকাংশ বসতবাড়ির ১০ থেকে ১শ’ গজের মধ্যে। বসতবাড়ির কাছে হওয়ায় ভাটার ধোঁয়া-বালিতে অতিষ্ট হয়ে উঠছে বাসিন্দারা।
গত সোমবার ডুমুরিয়ার খর্ণিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ইটভাটার চারপাশে মাটি ফেলে ভদ্রা নদীর চর ভরাট করে পুরো জমি উঁচু করা হয়েছে। খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে বড় বড় গর্ত করে মাটি তুলে ইট তৈরি করা হচ্ছে। আর কাঠ পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইট। ভাটার পাশে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য কয়েক শ‘ মণ কাঠ স্তূপ করে রাখা।
জানতে চাইলে কেবি ব্রিকসের মালিক ও সদর ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির বুলু মুঠোফোনে খুলনা গেজেটকে বলেন, ‘বেশির ভাগ জমিই স্থানীয় মালিকদের কাছ থেকে নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে একটি চুক্তি করে নেওয়া হয়েছে। আর কিছু জমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের। সেখানে আমরা শুধুমাত্র মাটি কেটে ফেলে রাখি। পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের কোনো অনুমোদন আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সবকিছুর অনুমোদন নিয়ে ইটভাটা পরিচালনা করছি।’ কৃষিজমিতে কীভাবে অনুমোদন পেলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২০ বছর আগে থেকে এই ভাটার কার্যক্রম চলে আসছে। তখন কৃষিজমি বোঝার উপয় ছিল না। এখন যারা ভাটা নির্মাণ করছে তারাই নদী ও কৃষি জমি ব্যবহার করতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।’ ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ২০১৩ অনুচ্ছেদ ৮-এর (গ) ধারা অনুযায়ী, সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, কৃষিজমি, বাগান ও জলাভূমি এলাকায় ইটভাটা স্থাপন দণ্ডনীয় অপরাধ।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, খুলনা জেলায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত ইটভাটার সংখ্যা ১৫৩টি। ভাটার রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্রতি বছর নবায়ণ করা লাগলেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাবে অধিকাংশ ইটভাটা নবায়ণ না করে কার্যক্রম চালিয়ে যায়।
খর্ণিয়া গ্রামের ইকবাল হোসেন বলেন, ভাটাগুলো প্রতিনিয়ত নদী মেরে ফেলছে। ইটভাটার শ্রমিকেরা রাতে বস্তার মধ্যে ইটের টুকরো ভরে ভাটার সামনে নদীতে ফেলছে। এতে পানি বাধা পেয়ে পলি জমার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে বাঁধ দিয়ে দিচ্ছে। এভাবে নদীকে মেরে ফেলা হচ্ছে।
রানাই গ্রামের মনিরুল ইসলাম বলেন, ভাটার ধোঁয়া আর বালিতে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়ছে। কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি করায় ফসলের আবাদ কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত বোঝাই দিয়ে ট্রাক-ট্রলি ইট বহনের কারণে রাস্তাটি দ্রুত নষ্ট হওয়ার পথে।
ডুমুরিয়ার আটলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রতাপ কুমার রায় জানান, প্রতিবছর ভাটার লাইসেন্স নবায়ণ করতে হলে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়। ইউনিয়নে ১১টি ইটভাটা থাকলেও চলতি অর্থবছরে কোনো ভাটার মালিক ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করেননি।
জানতে চাইলে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ‘সরকার বলছেন নদী বাঁচলে, বাঁচবে দেশ। আর ভাটা মালিকরা বলছে নদী মরণে আমরা বাঁচব। নদী দখল হলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লাভ বেশি। তারা খননের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট করতে পারবে। সেকারণে তারা কিছুই বলছে না। নদী ভরাট হলে নদীর পাশের বসবাসকারী ১০ থেকে ১৫ গ্রামের হাজারো মানুষ বছরের আট মাস পানির নিচে ডুবে থাকবে। তাছাড়া ভবদহের পানি নিষ্কাশন নিয়েও জটিলতার সৃষ্টি হবে।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক সাইফুর রহমান খান খুলনা গেজেটকে বলেন, পরিবেশ আইনের আওতায় যদি সঠিক থাকে, তাহলে সেই ইটভাটার অনুমোদন দিয়ে থাকি। তবে নদী দখল করে ভাটা থাকলে তা সম্পূর্ণ অবৈধ।
এ ব্যাপারে খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন খুলনা গেজেটকে বলেন, ‘যারা নদী দখল করছে বা অবৈধভাবে ভাটা চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আট লাখ টাকা জরিমানা সঙ্গে লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। ইটভাটার বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।’
খুলনা গেজেট / এআর