গত কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ এবং স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে খানজাহান আলী থানার তেলিগাতী কুয়েট রোডে অবস্থিত ৬ টি সরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান পানির নীচে তলিয়ে গেছে। গভঃল্যাবরেটরী হাইস্কুল এবং কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আজ বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) থেকে শুরু হওয়া এসএসসি এবং ভোকেশনাল পরীক্ষার্থীদের চরম দূর্ভোগ পোহাতে হয়।
পয়ঃনিস্কাশনের কোন ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলির অভ্যান্তরীণ রাস্তাগুলি পানিতে ডুবে গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলির ক্যাম্পাসে পানি থৈ থৈ করছে ।ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠানগুলির প্রশাসনিক ভবনে যেতে কর্মকর্তা কর্মচারী, প্রশিক্ষণার্থী, ছাত্র/ছাত্রীরা বিপাকে পড়েছে।
খুলনা টিচার ট্রেনিং কলেজের হিসাব রক্ষন অফিসার শেখ মোঃ মহিউদ্দিন খুলনা গেজেটকে বলেন, স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে আমাদের ছাত্র ছাত্রীরা ক্লাসে আসতে পারছেন না। ক্লাসের ভিতর পানি ঢোকায় শিক্ষকরা ক্লাস নিতে পারছেন না। ময়লা পানি এসে আমাদের ক্যাম্পাস ডুবে গেছে। সব মিলিয়ে আমরা মানবেতর জীবন যাপন করছি।
খুলনা মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ রিয়াজ শরীফ খুলনা গেজেটকে বলেন, মহিলা এবং পুরুষ মিলে টিটিসিতে প্রায় ৫০০ স্টুডেন্ট আছে। আমরা পরিবার নিয়ে প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে বসবাস করি। জলাবদ্ধতার কারণে বিভিন্ন ভোগান্তির সৃষ্টি হচ্ছে।
গভঃ ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক দুর্গেশ কুমার হালদার খুলনা গেজেটকে বলেন, জলাবদ্ধতার কারণে স্কুলের ১২০০ ছাত্র-ছাত্রী মাঠে নামতে পারে না। আশেপাশের পোকামাকড় বিল্ডিং এ আশ্রয় নিচ্ছে। আমাদের বিল্ডিং ও নিরাপদ নয়।
উদয়ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুলতানা নাজনীন খুলনা গেজেটকে বলেন, জলাবদ্ধতার কারণে সব সময় রাস্তার উপর পানি, ফলে আমাদের আসতে কষ্ট হয়, ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসতে পারে না।
এদিকে স্থায়ী জলাবদ্ধতা এবং ভারী বর্ষণের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলির আভ্যন্তরীন রাস্তাসমূহ ডুবে যাওয়ায় সাপ, মশকসহ নানাবিধ কীটপতঙ্গ দ্বারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে এ সব প্রতিষ্ঠানে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে অভিজ্ঞমহল আশংকা প্রকাশ করেছেন।
স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার প্রতিষ্ঠানগুলি হলো- সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, গভঃ ল্যাবরেটরী হাইস্কুল, খুলনা মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, খুলনা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং উদয়ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
জানা যায়, গত বছরের শুরুর দিকে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম অধিকতর সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সরকার অনুমোদিত প্রকল্পের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম পার্শ্বে ১৬ দশমিক ৫ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে বালি ভরাট করে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বালু ভরাটকৃত সম্প্রসারিত জায়গার উপর মাস্টারপ্লান তৈরী করে উন্নয়মূলক কাজ করছে। স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার প্রতিষ্ঠানগুলির কর্তৃপক্ষের অভিযোগ কুয়েট কর্তৃক ভূমি অধিগ্রহণকৃত জায়গার উপর দিয়ে একটি নালা বা খাল প্রবাহিত ছিল। যে নালা বা খাল দিয়ে এ সকল প্রতিষ্ঠানসহ আশেপাশের এলাকার পানি নিস্কাশিত হতো। ওই খালটি প্রায় অর্ধশত বছর ধরে কুয়েট কর্তৃপক্ষের ভরাটকৃত জায়গার উপর দিয়ে প্রবাহমান ছিল। বালু ভরাটের সময় খালটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে সেবামূলক এ প্রতিষ্ঠানগুলিতে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
গতবছর বর্ষা মৌসূমে এমন উদ্ভূত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইটি) মোঃ সাদিকুর রহমান খান সরজমিনে প্রতিষ্ঠানগুলি পরিদর্শন করে ভোগান্তি নিরসনে দ্রুত এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন।
এদিকে স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার প্রতিষ্ঠানগুলির প্রধান পৃথক পৃথকভাবে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সমাধানকল্পে কুয়েট কর্তৃপক্ষের নিকট ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানান।
জবাবে কুয়েটের ভাইস-চ্যাঞ্চেলর এর নির্দেশক্রমে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টার প্রকৌশলী মোঃ আনিছুুর রহমান ভূইয়া মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ বরাবর পাঠানো পত্রে উল্লেখ করেন ল্যাবরেটরী স্কুলের সামনে দিয়ে রাস্তার দক্ষিন পাশ দিয়ে নতুন করে ড্রেন নির্মাণ করার জন্য মেয়র সন্মতি জ্ঞাপন করেছেন। ওই ড্রেনটি বাইপাস রোড হয়ে রাজাপুর খালে গিয়ে পড়বে। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিগ্রহণকৃত ভূমির উন্নয়নের স্বার্থে আপনার প্রতিষ্ঠানের পানি নিস্কাশনের জন্য বিকল্প ড্রেনেজ ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করছি। যার স্বারক নং খু প্র বি/ ২৬৯১। তাং ০৬/০৫/২১ ইং।
ওই চিঠির জবাবে খুলনা মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ রিয়াজ শরীফ কুয়েটের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টার বরাবর পাঠানো পত্রে পানি নিস্কাশণের ওই নালা বা খালটি পুনরায় চালুকরনের দাবী জানিয়ে উল্লেখ করেন, বর্নিত পত্র মারফত বিকল্প ড্রেনেজ ব্যবস্থার যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে তা এসব প্রতিষ্ঠানের পানি নিস্কাশনের জন্য কোন ভাবেই বাস্তবসন্মত নয়। কারণ এই প্রতিষ্ঠাগুলি অপেক্ষাকৃত নীচু ভূমিতে অবস্থিত হওয়ায় মেয়রের প্রস্তাবিত ড্রেনের তল অপেক্ষা এসব প্রতিষ্ঠানের ভূমিপৃস্ট অনেক নীচু। ফলে এখানকার পানি প্রস্তাবিত ড্রেন দিয়ে অপসারিত হবে না। বরং উল্লেখিত ড্রেনের পানিদ্বারা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলি সয়লাব হয়ে যাবে। যার স্বারক নং ১৮৮। তাং ১৯ মে, ২০২১ ইং।
স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার ৫ টি প্রতিষ্ঠানের অভিযোগের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় কুয়েটের অবকাঠামো ও একাডেমিক কার্যক্রম সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মোঃ জুলফিকার হোসেনের।
তিনি খুলনা গেজেটকে বলেন, খালটি সেখানে ছিলো সেখানেই আছে। কুয়েটের উত্তর সাইডে খাস জমিতে একটা খাল আছে। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলে খালটি খনন করিয়েছি। এই খালের যে মাথা সেটার সাথে পানি প্রবাহের স্থায়ী কানেক্টেভিটি নেই। সেটা বন্ধ হয়ে আছে। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অনুরোধ কারেছি। সিটি কর্পোরেশনের সিটি মেয়রকে এনেছি। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এবং ওই প্রতিষ্ঠানগুলির প্রধানকে নিয়ে মিটিং করেছি। আমরা কিন্ত সবাইকে নিয়ে যাতে একটা পার্মানেন্ট সলুশন হয়, সে কাজটি করেছি। সাথে সাথে আমরা জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়ে এটা কিভাবে সমাধান করা যায় সেটা করেছি।
গত দেড় বছর যাবৎ স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার প্রতিষ্ঠানগুলির কর্তৃপক্ষ এবং কুয়েট কর্তৃক্ষের মধ্যে চিঠি চালাচালি আর দোষারোপ চলছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এ ব্যাপারে সেবামূলক ৬ টি সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা নিরশনের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবী জানিয়েছে।
খুলনা গেজেট/এমএম