খুলনা, বাংলাদেশ | ৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ | ১৮ মে, ২০২৪

Breaking News

  করোনায় একজনের মৃত্যু, শনাক্ত ১১
  তিন জেলায় বজ্রপাতে প্রাণ গেল ৭ জনের
  রাঙামাটিতে সশস্ত্র হামলায় ইউপিডিএফ সদস্যসহ নিহত ২
  সাতক্ষীরার তালায় ধানের ট্রাক উল্টে ২ শ্রমিক নিহত, আহত আরও ১১ জন

কুরআনের সর্ববৃহৎ সূরা আল-বাকারার পরিচয় ও ফজিলত

ডাঃ হাফেজ মাওলানা মোঃ সাইফুল্লাহ মানসুর

কুরআনের প্রত্যেকটা সূরার রয়েছে আলাদা আলাদা নাম, প্রেক্ষাপট ও নাযিলের পটভূমি। কোন সূরা বড়, কোন সূরা মধ্যম আবার কোন কোন সূরা খুব ছোট। এভাবেই আল্লাহ বৈচিত্রময় করে বিভিন্ন ছোট বড় সূরা দিয়ে সাজিয়েছেন মহাগ্রন্থ আল কুরআন। কুরআনের কোন সূরা হতে প্রকৃত শিক্ষালাভ করতে হলে পাঠকের অবশ্যই সূরার নাম করণ, নাযিলের প্রেক্ষাপট ও তার পটভূমি জানতে হবে। তানা হলে জ্ঞানের অপূর্ণতা থেকে যাবে। আজ আমরা কুরআনের সর্ববৃহৎ সূরা সূরা আল বাকারা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।

নাম ও নাম করণের নিয়ম: একটি সূরার বিভিন্ন উপায়ে নামকরণ করা হয়েছে; তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সূরার অভ্যন্তরে ব্যবহৃত কোনো শব্দকেই সূরার নাম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। আবার কোন কোন সময় সূরার শিক্ষাকে সামনে রেখে নামকরণ করা হয়েছে । এছাড়া এমন নামও পাওয়া যায় যা সূরার অভ্যন্তরে ব্যবহৃত হয়নি অথচ অন্য একটি শব্দ দিয়ে সূরার নামকরণ করা হয়েছে, যেমন সূরা ফাতিহা। ফাতিহা শব্দটি এ সূরার কোথাও উল্লেখ নেই। অনুরূপভাবে সূরা বাকারার এক জায়গায় গাভীর নাম এবং গাভী নিয়ে একটি চমকপ্রদ ঘটনা উল্লেখ থাকার কারণে বাকারা নামকরণ করা হয়েছে। বাকারাহ অর্থ গাভী ।

নাযিলের সময়কাল : সূরা বাকারার সম্পূর্ণ অংশই মাদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং মাদীনার প্রথম যুগে যে সব সূরা সমূহ অবতীর্ণ হয়েছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। এ বিষয়ে সকল ওলামায়েকেরাম একমত। এর মধ্যে এক হাজার সংবাদ, এক হাজার আদেশ এবং এক হাজার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

নাযিলের প্রেক্ষাপট : হিজরাতের আগে ইসলামের দাওয়াতের কাজ চলছিল কেবলমাত্র মক্কায় । তাদের কাছে ইসলামের বাণী ছিল সম্পূর্ণ নতুন ও অপরিচিত । এখন হিজরাতের পরে মদিনার ইহুদিরা মুসলমানদের সামনে এসে গেল । তাদের জনবসতিগুলো ছিল মদীনার সাথে একেবারে লাগানো । ইহুদিরা তাওহীদ, রিসালাত, অহী , আখেরাত ও ফেরেশতার স্বীকৃতি দিত। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের নবী মূসা আলাইহিস সালামের ওপর যে শরিয়াতী বিধান নাযিল হয়েছিল তারও স্বীকৃতি দিত । নীতিগতভাবে তারাও সেই দীন ইসলামের অনুসারী ছিল যার শিক্ষা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিয়ে চলছিলেন । কিন্তু বহু শতাব্দী কালের ক্রমাগত পতন ও অবনতির ফলে তারা আসল দ্বীন থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল । তাদের আকীদা-বিশ্বাসের মধ্যে বহু অনৈসলামিক বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল যা তাওরাতে এগুলোর কোন ভিত্তি ছিল না । তাদের কর্মজীবনে এমন অসংখ্য রীতি-পদ্ধতির প্রচলন ঘটেছিল যা দ্বীনের সাথে সেগুলোর কোন সম্পর্ক ছিল না । তাওরাতের মধ্যে তারা মানুষের মনগড়া কথা মিশিয়ে দিয়েছিল । শাব্দিক বা অর্থগত দিক দিয়ে আল্লাহর কালাম যতটুকু পরিমাণ সংরক্ষিত ছিল তাকেও তারা নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিকৃত করে ফেলেছিল ।

লোক দেখানো ধার্মিকতার নিছক একটা নিস্প্রাণ খোলসকে তারা বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল । তাদের উলামা,মাশায়েখ, জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও জনগণ সবার আকীদা-বিশ্বাস এবং নৈতিক ও বাস্তব কর্ম জীবন বিকৃত হয়ে গিয়েছিল । নিজেদের এই বিকৃতির প্রতি তাদের আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিল যে, যার ফলে কোন প্রকার সংস্কার সংশোধন গ্রহণের জন্য তারা প্রস্তুতি ছিল না । যখনই কোন আল্লাহর বান্দা তাদেরকে আল্লাহর দ্বীনের সরল-সোজা পথের সন্ধান দিতে আসতেন তখনই তারা তাঁকে নিজেদের সবচেয়ে বড় দুশমন মনে করে সম্ভাব্য সকল উপায়ে তার সংশোধন প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার জন্য উঠে পড়ে লাগতো। শত শত বছর ধরে ক্রমাগতভাবে এই একই ধারার পুনরাবৃত্তি হয়ে চলছিল । এরা ছিল আসলে বিকৃত মুসলিম । দ্ব্ীনের মধ্যে বিকৃতি , দ্বীন বহির্ভূত বিষয়গুলোর দ্বীনের মধ্যে অনুপ্রবেশ, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি , দলাদলি , বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বাদ দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে মাতামাতি , আল্লাহকে ভুলে যাওয়া ও পার্থিব লোভ-লালসায় আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যাওয়ার কারণে তারা পতনের শেষ প্রান্তে পৌছে গিয়েছিল । এমন কি তারা নিজেদের আসল ‘মুসলিম’নামও ভুলে গিয়েছিল । নিছক ‘ইহুদি’ নামের মধ্যেই তারা নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছিল ।

আল্লাহর দ্বীনকে তারা কেবল ইসরাঈল বংশজাতদের পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত উত্তরাধিকারে পরিণত করেছিল । কাজেই নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় পৌছার পর ইহুদিদেরকে আসল দ্বীনের দিকে আহবান করার জন্য আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিয়ে সূরা বাকারা নাযিল করলেন। এ সূরায় তাদের নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার সমালোচনা করা হয়েছে এবং যেভাবে তাদের বিকৃত ধর্ম ও নৈতিকতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের মোকাবিলায় যথার্থ দ্বীনের মূলনীতিগুলো তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে লোক দেখানো আনুষ্ঠানিক ধার্মিকতার মোকাবিলায় যথার্থ ধার্মিকতা কাকে বলে , সত্য ধর্মের মূলনীতিগুলো কি এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে কোন কোন জিনিস যথার্থ তা গুরুত্বের সাথে সূরা বাকারায় তুলে ধরা হয়েছে ।

আয়াত সংখ্যা : এটি কুরআনের সর্ব বৃহৎ সূরা যার আয়াত সংখ্যা রয়েছে ২৮৬ টি । এর শব্দ হচ্ছে ছয় হাজার দু’শ’ একুশটি এবং এতে অক্ষর আছে পঁচিশ হাজার পাঁচশ’টি।

পড়ার ফজিলত : সূরা বাকারা পড়ার মধ্যে রয়েছে অনেক বরকত ও ফজিলত। সূরা বাকারা পাঠ করার জন্য হুজুর সা: উৎসাহিত ও তাগিদ দিয়েছেন এবং পাঠ না করা দুর্ভাগ্য ও অনুতাপের কারণ সাব্যস্ত করেছেন। যেমন নবী করিম সা: ইরশাদ করেন, তোমরা সূরা বাকারা বেশি বেশি পাঠ করো। কারণ এই সূরা পাঠ করলে বরকত লাভ হয় ও পাঠ না করা অনুতাপ ও দুর্ভাগ্যের কারণ। যে ব্যক্তি এ সূরা পাঠ করে, কোনো জাদুকরের জাদু কখনো তার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে না (বুখারি)।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ‘তোমরা নিজেদের ঘরকে কবরে পরিণত করো না, যে ঘরে সূরাহ্ আল বাক্বারাহ্ পাঠ করা হয় সেখানে শায়তান প্রবেশ করতে পারে না।’ (হাদীসটি সহীহ। সহীহ মুসলিম ১/২১২, ৫৩৯, মুসনাদ আহমাদ ২/২৮৪, ৩৩৭, জামি‘ তিরমিযী ৫/২৮৭৭, নাসাঈ ৫/১৩/৮০১৫। ইমাম তিরমিযী (রহঃ) একে হাসান সহীহ বলেছেন) আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ)-এর উক্তি আছে যে, যে ব্যক্তি রাতে সূরাহ্ আল বাক্বারার দশটি আয়াত তিলাওয়াত করে, সে রাতে উক্ত ঘরে শায়তান প্রবেশ করেনা। আর সে আয়াতগুলো হলো উক্ত সূরার প্রথম চারটি আয়াত, আয়াতুল কুরসী, তার পরবর্তী দু’টি আয়াত এবং সবশেষের তিনটি আয়াত। অন্য বর্ণনায় আছে যে, শায়তান সে ঘরে ঐ রাতে যেতে পারে না এবং সেদিন ঐ বাড়ীর লোকদের শায়তান অথবা কোন খারাপ জিনিস কোন ক্ষতি করতে পারে না।

এ আয়াতগুলো পাগলের ওপর পড়লে তার পাগলামীও দূর হয়ে যায়। (দারিমী ২/৩২২) সহীহুল বুখারীতে রয়েছে, ‘উসাইদ ইবনু হুজাইর (রাঃ) একবার রাতে সূরাহ্ বাকারাহ পাঠ করেন। তাঁর ঘোড়াটি, যা তাঁর পার্শ্বেই বাঁধা ছিলো, হঠাৎ করে লাফাতে শুরু করে। তিনি পাঠ বন্ধ করলে ঘোড়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আবার তিনি পড়তে আরম্ভ করলে ঘোড়াও লাফাতে শুরু করে। তিনি পুনরায় পড়া বন্ধ করেন এবং ঘোড়াটিও স্তব্দ হয়ে থেমে যায়। তৃতীয় বারও এরূপই ঘটে। তাঁর শিশু পুত্র ইয়াহ্ইয়া ঘোড়ার পাশেই শুইয়ে ছিলো। কাজেই তিনি ভয় করলেন যে, না জানি ছেলের আঘাত লেগে যায়। সুতরাং তিনি পড়া বন্ধ করে ছেলেকে উঠিয়ে নেন। তারপর তিনি আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করেন যে, ঘোড়ার চমকে উঠার কারণ কি? সকালে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দরবারে হাযির হয়ে ঘটনাটি বর্ণনা করেন। তিনি শুনতে থাকেন ও বলতে থাকেনঃ ‘উসাইদ! তুমি পড়েই যেতে! ‘উসাইদ (রাঃ) বলেনঃ ‘হে মহান আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তৃতীয় বারের পরে প্রিয় পুত্র ইয়াহ্ইয়ার কারণে আমি পড়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। অতঃপর আমি মাথা আকাশের দিকে উঠালে ছায়ার ন্যায় একটি জ্যোতির্ময় জিনিস দেখতে পাই এবং দেখতে দেখতেই তা ওপরের দিকে উত্থিত হয়ে শুন্যে মিলে যায়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ ‘তুমি কি জানো সেটা কি ছিলো? তাঁরা ছিলো গগণ বিহারী অগণিত জ্যোতির্ময় ফিরিশতা। তোমার পড়ার শব্দ শুনে তাঁরা ত্রস্তপদে নিকটে এসেছিলো। যদি তুমি পাঠ বন্ধ না করতে তাঁরা সকাল পর্যন্ত এরকমই থাকতো এবং মাদীনার সকল লোক তা দেখে চক্ষু জুড়াতো। একটি ফিরিশতাও তাদের দৃষ্টির অন্তরাল হতো না। সহীহুল বুখারী ৮/৫০১৮, সহীহ মুসলিম ১/২২৪/৫৪৮, মুসনাদ আহমাদ ৩/৮১। ফাতহুল বারী ৮/৬৮০)।

খতিব
থুকড়া বায়তুস সালাম কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ
ডুমুরিয়া, খুলনা




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!