খুলনা, বাংলাদেশ | ১৩ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  আইনজীবী আলিফ হত্যা : ভিডিও দেখে শনাক্ত ১৩ জন, গ্রেপ্তার ৭
সুন্দরবন উপকূলীয় লোকালয়ে গড়ে ওঠা শতাধিক অবৈধ কারখানা বন্ধে অভিযান শুরু

কাঠ পুড়িয়ে কয়লা, স্বস্তিতেও কাটছেনা শঙ্কা

শেখ নাদীর শাহ্, পাইকগাছা

খুলনার পাইকগাছায় একটি অঞ্চল জুড়ে বাতাসে পোড়া কাঠের উটকো গন্ধ। বিষাক্ত বাতাসে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে বাড়ছে বায়ুবাহী রোগ-জীবানুর সংক্রমণ। নাকে-মুখে কাপড় গুজেও রাস্তা পার হতে পারেন না পথচারীরা। পাইকগাছার চাঁদখালী-কয়রা সড়কের পশ্চিম পাশ দিয়ে কয়রার নাকশা অভিমুখে সারি সারি গড়ে ওঠা কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির শতাধিক অবৈধ চুল্লি থেকে নির্গত অবিরাম ধোঁয়ায় এমন পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। প্রভাব আর প্রতিপত্তির মুখে সরাসরি প্রতিরোধ সম্ভব না হলেও খানিকটা সোচ্চার হয়ে উঠেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগের পর এসব অবৈধ চুল্লি ধ্বংসে অভিযান শুরু করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসন। প্রশ্নবিদ্ধ প্রক্রিয়ায় বুধবার (৭ সেপ্টেম্বর) যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত ৫ টি অবৈধ কয়লা তৈরির কারখানা (চুল্লি) ভেঙ্গে দেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এর কার্যক্রম। এ সময় আদালত আগামী এক মাসের মধ্যে সকল কারখানাসহ কয়লা তৈরির যাবতীয় সরঞ্জমাদি নিজ দায়িত্বে সরিয়ে নেওয়ারও নির্দেশনা দিয়েছেন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেট মোঃ আসিফুর রহমান, জেলা কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক আবু সাঈদ, পরিদর্শক মারুফ বিল্লাহ, পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগমের সমন্বয়ে পরিচালিত অভিযানে উপস্থিত ছিলেন পেশকার ইব্রাহীম হোসেন ও আনসার সদস্যরা।

আদালত সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, এদিন অভিযান পরিচালনাকালে চুল্লিগুলো জলন্ত থাকায় বহুলাংশে ব্যহত হয় এর কার্যক্রম। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তাৎক্ষণিক পার্শ্ববর্তী আশাশুনি থেকে ফায়ার সার্ভিসকে ডেকে নিয়ে আগুন নিভিয়ে পরিচালিত হয় উচ্ছেদ কার্যক্রম। এর আগে এসব চুল্লি নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় গুরুত্ব সহকারে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। দেরিতে হলেও সর্বশেষ সেখানে অভিযান শুরু করল খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরসহ উপজেলা প্রশাসন। তবে অভিযানে স্থানীয়দের মধ্যে সাময়িক স্বস্তি ফিরলেও শঙ্কা কাটেনি। পুরোপুরি সকল চুল্লি উচ্ছেদের আগেই এর মালিকরা ফের স্বরুপে ফিরতে পারে বলেও আশংকা করছেন কেউ কেউ।

সরেজমিনে দেখা যায়, খুলনার পাইকগাছা উপজেলার চাঁদখালী-কয়রা প্রধান সড়কের পশ্চিম পাশ দিয়ে কয়রার নাকশা পর্যন্ত গড়ে উঠেছে অন্তত ৭০ টিরও বেশি কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির অবৈধ কারখানা (চুল্লি)। এসব চুল্লিতে প্রতিদিন পুড়ছে হাজার হাজার মণ কাঠ। চুল্লি এলাকা থেকে আশপাশের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে বাতাসে চুল্লি থেকে অবিরাম নির্গত বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। স্বাভাবিক নি:শ্বাস নিতেও কষ্ট হয় এসব এলাকার বাসিন্দাদের। প্রকাশ্যে গড়ে ওঠা এসব চুল্লির অবাধে নির্গত ধোঁয়ায় পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি রীতিমত স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে সুন্দরবন উপকূলীয় জনপদের লাখ লাখ মানুষ।

অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব চুল্লির কোনটারই নেই বৈধ কোন কাগজ-পত্র। প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়াই স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে পরিচালিত হয় এসব বায়ুদূষণ কারখানা। এসব চুল্লি মালিকদের সমন্বয়ে আবার সংগঠনও রয়েছে। মূলত সংগঠনের ছায়াতলে এক প্রকার সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই পরিচালিত হয় অবৈধ এ বায়ু দূষণ ব্যবসা।

এর আগে এলাকাবাসির পক্ষে এসব অবৈধ চুল্লি বন্ধে খুলনা বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ হয়। অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়, উপজেলার চক্কাওয়ালীর মৃত মোহতেজ সরদারের ছেলে মো: আব্দুল হালিম খোকনের মালিকানাধিন ৮ টি, মো: রেয়াজ উদ্দিন ছোট্টুর ছেলে মো: হালিম রেজা মিন্টুর ৫টি, মো: সেলিম রেজা লিটুর ৫টি, মৃত মনির উদ্দীন গাজীর ছেলে মো: মশিউর রহমানের ২টি, মৃত মোনতেজ সরদারের ছেলে মো: ইলিয়াস সরদারের ৩টি, মো: শাহাদাৎ সরদারের ৫টি, মৃত মালেক সরদারের ছেলে আব্দুস সালাম সরদারের ২টি, হাফিজ সরদারের ৩টি, সাঈদ সরদারের ৪টি, গোলাম গাজীর ছেলে জয়নাল আবেদীনের ৩টি, মৃত আবু বক্কার গাজীর ছেলে মো: শাহিদুর গাজীর ১টি, মৃত ছাত্তার সরদারের ছেলে সোবহান সরদারের ২টি, মৃত সরল ইুদ্দন গাজীর ছেলে আব্দুর রাজ্জাক গাজীর ৩টি, কানুয়ারডাঙ্গার সামাদ সরদারের ছেলে মো: জিয়া সরদারের ২টি, কালিদাশ পুরের মৃত সুলতান সরদারের ছেলে মো: নজরুল ইসলাম সরদারের ১০টি, মৃত নুর ইসলাম মাওলানার ছেলে ইনামুল হক গাজীর ৮টি ও বারিক সরদারের ছেলে ফেরদাউস সরদারের মালিকানাধিন ১টিসহ স্ব-নামে বে-নামে এলাকাটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রায় শতাধিক অবৈধ কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির চুল্লি।

এসব চুল্লি পরিচালনায় বৈধ কোন অনুমোদন বা লাইসেন্স আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মালিক পক্ষের একাধিক ব্যাক্তি জানান, তাদের কোনো লাইসেন্স লাগে না, তাদের কমিটিই বিভিন্ন জায়গায় সার্বিক সমস্যা বা সংকট মোকাবেলা করে থাকে।

বছরের পর বছর ধরে জনপদটিকে ঘিরে গড়ে ওঠা এসব চুল্লির বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসন কিংবা বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষে কার্যত কোন অভিযান পরিচালনা হয় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে জনৈক চুল্লি মালিক বলেন, বছরে দু’ একবার খুলনা থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাঅভিযানে আসলেও আগাম খবরে সাময়িক বন্ধ রাখা হয় কারখানাগুলো।

এব্যাপারে উপজেলা নিরাপদ খাদ্য ও সেনেট্যারী কর্মকর্তা উদয় কুমার মন্ডল জানান, কাঠ পোড়ানোর ফলে কার্বন ও সীসা উৎপন্ন হয়ে তা বাতাসে মিশে যায়। যে এলাকায় কাঠ পুড়িয়ে কয়লা উৎপাদন করা হয়, ওই এলাকায় চুল্লির ধোঁয়ায় মানব শরীরে শ্বাসকষ্টজণিত রোগ, অ্যালার্জি, চর্মরোগ, চোখের সমস্যাসহ নানা ধরনের রোগ দেখা দিতে পারে।

পাইকগাছা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগম বলেন, কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির কোনো অনুমতি কাউকে দেওয়া হয়নি। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে অভিযান শুরু হয়েছে। যা অব্যাহত থাকবে।

পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনার উপ-পরিচালক মো: আসিফুর রহমান জানান, অভিযান শুরু হয়েছে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের অনুরোধে কিছুদিন সময় দেওয়া হয়েছে। আগামী দিন সকল অবৈধ চুল্লি উচ্ছেদ বাস্তবায়ন করা হবে।

খুলনা গেজেট/ টি আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!