খুলনা, বাংলাদেশ | ১০ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৪শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  ড. ইউনূসের প্রতি প্রধান তিন রাজনৈতিক দলের অকুণ্ঠ সমর্থন: প্রেস সচিব

কাজী নজরুল : এক অনন্ত প্রেরণার শব্দবন্ধ

রুশাইদ আহমেদ

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র কাজী নজরুল ইসলাম। প্রবন্ধ, গান, গল্প, নাটক, উপন্যাস আর কবিতার বাক্য ও পঙক্তিমালাতে তিনি আজন্ম করে গেছেন সাম্য, প্রেম, বেদনা ও দ্রোহের উদ্দীপ্ত গাঢ় উচ্চারণ। ধর্মনিরপেক্ষতা আর মানবতার অমোঘ সম্মিলনে গড়া তাঁর সৃষ্টিকর্মের রাজ্য তাই ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠেছে আমাদের চিন্তা-চেতনা ও মানসিক শক্তির সুদৃঢ় ভিত্তিমূল।

সাহিত্য অঙ্গণে অনবদ্য ভূমিকা রাখার পাশাপাশি অভিনয় ও চলচ্চিত্র পরিচালনায়ও কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সফল। এককথায় বলতে গেলে সমসাময়িক সময়ে বাংলা শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক আশ্চর্য শক্তির নাম। এটি হলো এমন এক অপরিমেয় সৌকর্য, যাকে কেউ অতিক্রম করে উঠতে পারে না।

এর পাশাপাশি, একজন কণ্ঠশিল্পী ও সম্পাদক হিসেবেও নজরুল নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। কিন্তু এসব পরিচয়ের বাইরেও ছিল তাঁর এক সংবেদনশীল অভিমানী হৃদয়, যে হৃদয় নিপীড়িতদের আহাজারি গভীরভাবে অনুভব করত। আর এ কারণেই তাঁর কবিতাগুলো যেন শুধু শব্দের বিন্যাস নয়। বরং সেগুলো হয়ে উঠেছিল নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক ধারালো অস্ত্র, যা তরুণদের রক্তে প্রজ্বলিত করতো প্রতিবাদের ন্যায়বাদী বহ্নিশিখা!

ইতিহাস আমাদের জানায়, ১৮৯৯ সালের ২৪ মে, অর্থাৎ বঙ্গাব্দ ১৩০৬-এর ১১ জ্যৈষ্ঠ নাগাদ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নজরুল। শৈশব ও কৈশোরে তাঁকে নানা রকম অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। পেতে হয়েছে দুখু মিয়া’-এর মতো ডাকনাম। জীবিকার তাগিদে রুটি বিক্রি থেকে শুরু করে লেটো গানের দলে কাজ করাসহ জীবনের বহু প্রতিকূল অধ্যায় পেরিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজের সৃজনশীল পথচলার সোপান।

এমনকি ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ময়দানেও অবতীর্ণ হন তিনি। সেনাবাহিনীতে থাকাকালীনই সাহিত্যচর্চা শুরু করেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রেই রচনা করেন একাধিক কবিতা ও গল্প। পরে যুদ্ধ শেষে পুরোপুরি সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন তিনি। আসেন তৎকালীন বহু খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকের সংস্পর্শে। যা তাঁর মেধা ও মননকে করে তোলে আরও স্বকীয়, আরও বিকশিত।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯২২ সালে ‘ধূমকেতু’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। সেখানে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে পঙক্তি রচনা করতে শুরু করেন নজরুল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে বাংলা অঞ্চলে তিনি সমাদৃত হয়ে ওঠেন বিদ্রোহী কবি হিসেবেও।

সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে তাঁর বিদ্রোহী সত্তার স্ফূরণ ঘটতে থাকে আরও। এর সূত্র ধরে ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুল রচিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা কাঁপিয়ে দেয় তৎকালীন ব্রিটিশ দুঃশাসনের ভিত। ফলে এক বছরের কারাদণ্ডের শাস্তি নেমে আসে নজরুলের কপালে। তাঁকে উৎসর্গ করে কবিতা লেখেন আরেক সমকালীন কিংবদন্তি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এমন আরও অনেক ঘটনাই রয়েছে এই দুখু মিয়ার।

গল্প আর উপন্যাসেও কম যান না নজরুল। ‘ব্যথার দান’ কিংবা ‘রিক্তের বেদন’ তাঁর বেদনাকাতর অভিমানী সত্তার অমায়িক সৃজনগুলোর মধ্যে অন্যতম। ‘বাঁধনহারা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’ ও ‘কুহেলিকা’-তেও তিনি তুলে ধরেছেন সমসাময়িক সমাজজীবন, রাজনীতি ও মানবীয় সম্পর্কের নিজস্ব স্বকীয় ভাবনার নির্যাস।

নজরুলের নাটকগুলোতে তুলনামূলকভাবে সংগীত, কাব্য ও নাট্যরীতির মেলবন্ধন দেখা যায়। তাঁর নাট্যসৃষ্টি মূলত সংগীতনির্ভর হলেও এতে রয়েছে গভীর মানবতাবোধ, সাম্য ও প্রেমের দর্শনের অনিঃশেষ সম্ভাবনার সারকথা। ‘ঝিলিমিলি’, ‘আলেয়া’, ‘মধুমালা’, প্রভৃতি নাটকগুলো এটাই প্রমাণ করে।

তবে মোদ্দাকথা হলো নজরুলের এসব অজস্র গান, গজল, কবিতা, নাটক, গল্প ও উপন্যাস মাত্র ২২ বছরের সাহিত্যজীবনে সৃষ্ট। তাঁর সংগীতচর্চা তো বাংলা গানের জগতকে উন্নীত করেছে এক নতুন মাত্রায়। যা পরে “নজরুলগীতি” নামে পৃথক শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা সংস্কৃতিতে। চলচ্চিত্র পরিচালনা ও অভিনয়েও তিনি রেখেছেন তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর। তাঁর পরিচালিত ‘ধ্রুব’ চলচ্চিত্রে তিনি নিজেই অভিনয় করেন।

অগণিত বিখ্যাত গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস, কবিতা ও গানের স্রষ্টা এই নজরুল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশিদের প্রেরণা জোগাতেও কলম ও কালি নিয়ে ছিলেন পাশে। ফলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার তাঁকে সপরিবারে ঢাকায় নিয়ে আসে। দেওয়া হয় নাগরিকত্ব। নজরুল হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি।

এরপর থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশেই অবস্থান করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট, ঢাকার পিজি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই বিদ্রোহের মহাকবি। তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে সমাহিত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে।

চলতি বছরের ২৪ মে পালিত হলো তাঁর ১২৬তম জন্মবার্ষিকী। যুগের পর যুগ পেরিয়ে চুরুলিয়ার সেই রুটি বানানো কিশোরটির নাম যে এখনও উচ্চারিত হয়ে আসছে এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যের। কেননা কাজী নজরুল কেবল একজন কবি নন। তাঁর নাম বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির এক বিশাল অধ্যায়, এক অবিস্মরণীয় প্রতিষ্ঠান। এক অনন্ত প্রেরণার শব্দবন্ধ।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!