শিবানী গাইন, সপ্তম শ্রেণিতে পড়াবস্থায় একটি দারিদ্র পরিবারে বিয়ে হয়। স্বামীর ক্ষুদ্র আয়ে ঠিকমত সংসার চলতো না। জীবিকার তাগিদে অন্যের বাড়িতে ঝি’র(গৃহস্থলীর) কাজ করতেন তিনি। কখনও কখনও দিনমজুরী হিসেবে মাটি কাটা, ক্ষেতের ঘাস পরিষ্কার করা এমনকি ধান কাটার কাজও করতে হত তাকে। তরমুজ চাষ করে তার জীবনচিত্র পাল্টে গেছে। তিন বছর পূর্বে দুই বিঘা জমি লিচ নিয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে তরমুজ চাষ শুরু করেন। ওই বছর খরচ বাদে এক লাখ টাকা লাভ হয়। সেই থেকে আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। শিবানী গাইন খুলনার কয়রা উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের বারপোতা গ্রামের প্রদীপ চন্দ্র গাইনের স্ত্রী। এ মৌসুমে তিনি কয়রার বাগালী ইউনিয়নের বারোপাতা বিলে ২১ বিঘা জমিতে তরমুজ আবাদ করেছেন। ভালো লাভবান হবেন বলে আশা করছেন।
আমাদী ইউনিয়নের চণ্ডীপুর গ্রামের জুবায়ের রহমান গত বছর ৩০ বিঘা জমির তরমুজ বিক্রি করে ১৬ লাখ টাকা পেয়েছিলেন। এ বছর তিনি ৫০ বিঘা জমিতে চাষ করেছেন।
আমাদী ইউনিয়নের চাষি রঞ্জন এ বছর তরমুজ চাষ করেছেন বাগালী ইউনিয়নের চটকাতোলা বিলে। পরিবার নিয়ে সেখানে অস্থায়ীভাবে বসবাসও শুরু করেছেন। ২১ বিঘা জমি লিচ নিয়ে চাষাবাদ করছেন। তিনি বলেন, আমাদী ইউনিয়নের চেয়ে বাগালী জমির হারি অনেক কম। এছাড়া আমাদী ইউনিয়নে কোথাও কোনো জমি ফাঁকা থাকছে না। এজন্য বাগালী ইউনিয়নে এসেছি। এছাড়া নতুন জায়গায় ফলন ভালো হবে বলে আশা করছেন। তিনি জানান, ৬/৭ বছর যাবৎ তরমুজ চাষ করছেন। সংসারের অভাব কাটিয়ে দুই বিঘা জমিও কিনেছেন।
শুধু শিবানী গাইন, জুবায়ের ও রঞ্জন নয়, কয়রা উপজেলার শত শত পরিবার তরমুজ চাষের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। প্রতিবছর নতুন নতুন বিলে তরমুজ চাষ সম্প্রসারণ হচ্ছে, আর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের।
সরেজমিন খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রার বিভিন্ন বিল পরিদর্শণ করে দেখা যায়, লবনাক্ত আবহাওয়ার মধ্যে মাঠের পর মাঠ তরমুজের সবুজ ক্ষেত। রাস্তায় নোনা ধুলা উড়লেও মাঠে রয়েছে সারিসারি তরমুজ। ফলন এসেছে অধিকাংশ গাছে। কিছু গাছ থেকে তরমুজ তোলা শুরু হয়েছে। এখনো ভরামৌসুম শুরু হয়নি। আগামী এক মাসের মধ্যে পুরোদমে শুরু হবে তরমুজ তোলা ও বিক্রয়ের কাজ।কৃষকেরা তরমুজ ক্ষেতের পরিচর্যায় ব্যস্ত। কেউ ক্ষেতে সেচ দিচ্ছেন, কেউ সার কিংবা ওষুধ দিচ্ছেন, আবার কেউবা ক্ষেত থেকে তরমুজ তুলছেন। অনেকে তরমুজ ক্ষেত পাহারা দিতে ক্ষেতের মধ্যে থাকার জন্য ছোট ছোট ঘর করেছেন। সেখানে আবার সোলার সিস্টেমের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থাও করেছেন তাঁরা।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কয়রায় মূলত আমন নির্ভর কৃষিব্যবস্থা চালু ছিল। লবণাক্ততা ও পানিসংকটের কারণে এখানকার কৃষক বোরো চাষে খুব একটা আগ্রহী হন না। গত কয়েক বছর আগেও এখানকার জমি আমন ধান চাষের পর অনাবাদি পড়ে থাকত। সেই জমিগুলোই স্বপ্ন দেখাচ্ছে চাষিদের। অল্প সময়ে বিনিয়োগের দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ লাভ হওয়ায় আগ্রহী হয়ে উঠছেন উপকূলের চাষিরা।
আরও জানা যায়, কয়রা উপজেলার আমাদী ইউনিয়নের কয়েকটি বিলে প্রথম তরমুজ চাষ শুরু হয়। ভালো ফলন ও লাভ দেখে অন্যান্য ইউনিয়নেও তরমুজ চাষ সম্প্রসারণ হয়েছে। গেল বছরের তুলনায় বাগালী ইউনিয়নে তরমুজ চাষ বেড়েছে প্রায় ১২ গুণ। আমাদী ইউনিয়নের অভিজ্ঞ চাষিরা এখন বাগালী ইউনিয়নে এসে জমি লিচ নিয়ে তরমুজ চাষ করছেন।
আরও জানা যায়, তরমুজ চাষে সব মিলিয়ে বিঘাপ্রতি ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। আর বিঘাপ্রতি ৬০ হাজার টাকা থেকে একলাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
কয়রা উপজেলা কৃষি দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে কয়রা উপজেলায় মাত্র ৬৫ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছিল। উৎপাদন হয়েছিল ২ হাজার ৪৭০ মেট্রিক টন। পরের বছর দশ গুণ বেশি হয়ে ৬৫০ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়। উৎপাদন হয়েছিল ২৯ হাজার ২৪৯ মেট্রিক টন। ওই বছর চাষি ভালো দাম পাওয়ায় ২০২২ সালে উপজেলায় তরমুজ আবাদের জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৯৫ হেক্টরে। উৎপাদন হয়েছিল ৩১ হাজার ৬৪ মেট্রিক টন। এরপর ২০২৩ সালে উপজেলায় তরমুজ আবাদের জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ২০০ হেক্টরে। গত বছর উৎপাদন হয়েছিল ৪৪ হাজার ৫২৮ মেট্রিক টন। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে চলতি বছর সবচেয়ে বেশি জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন কৃষকেরা। এ বছর উপজেলায় তরমুজ আবাদের জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯৩০ হেক্টরে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৯৬০ মেট্রিক টন।
কয়রা উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আল মাহফুজ বলেন, গত বছর বাগালী ইউনিয়নে ৫০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয় এবং অনেক বড় সাইজের তরমুজ উৎপাদন হয়। এবছর ৬১০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। ইসলামপুর, বগা, মালিখালী, চটকাতলা, বারোপোতা, উলাসহ বেশ কয়েকটি বিলে তরমুজ চাষ হচ্ছে। নতুন নতুন বিল আবাদের আওতায় আসছে। চাষিরা পাকিজা, সুইট ড্রাগণ, মারভেলাস, আনারকলিসহ কয়েকটি জাতের তরমুজ চাষ করেছেন।
কয়রা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, কয়রার কৃষি অর্থনীতিতে তরমুজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কয়রার তরমুজে স্বাদ বেশি হওয়ায় বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চলতি মৌসুমে তরমুজের ব্যাপক আবাদ বেড়েছে। এবার কয়রার অনেক এক ফসলি বিলে প্রথমবারের মতো তরমুজ আবাদ হয়েছে। আবহাওয়া শেষ পর্যন্ত অনুকূলে থাকলে উৎপাদন অনেক ভালো হবে ইনশাল্লাহ।
তিনি আরও বলেন, তরমুজের শেষ সময়ে সেচ সংকট তীব্র হয়ে ওঠে। চাষিদের সেচের সুবিধার্থে মিনি পুকুর ও খাল খননের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে কিছু কৃষক সেচের সুবিধা পাচ্ছে।