‘দিবানিশি স্বপ্নের খেলা’ কাব্যে কবি আধুনিক জীবনের সবৈব জটিলতা আত্মস্থ করেই বাংলা কাব্যাঙ্গনে আবির্ভূত হয়েছেন আপন আলোয়। আত্মমগ্ন চেতনার গভীরে কবির কাছে একান্ত যা আশ্রয়, তারই বহিরাগত রূপ গড়ে উঠেছে এ কাব্যের প্রতিটি কবিতায়। কবিতার ভাব, ব্যঞ্জনা, ইঙ্গিত, উপমা, অলংকার আর উৎপ্রেক্ষার নিটোল বন্ধন প্রস্ফুটিত হয়েছে কবির নিঁখুত ভঙ্গিমার উপস্থাপনায়।
কবি মিজানুর রহমান তোতা পেশায় একজন সাংবাদিক। কিন্তু নেশা তাঁর কবিতা লেখা। দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে সাংবাদিকতায় আছেন। তিনি খুব নিগূঢ়ভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন মানব জীবনের সুখ, দুঃখ, দুর্দশা, বেদনা প্রবাহ জীবন, আশা, আকাঙ্ক্ষা, সমাজচিত্র আর বাস্তবতার প্রলেপ।তিনি আরো উপলব্ধি করেছেন প্রেম-ভালোবাসা, স্বপ্ন, সাধ, দ্রোহ ও হতাশা, অভিমান। বাস্তব জীবনে স্ত্রী বিয়োগের যে তীব্র ব্যথা-বেদনা তা যেন কবিতায় বেদনার নীলকন্ঠ হয়ে ধরা দিয়েছে। তারই প্রমাণ ‘নিঃসঙ্গ জীবনের অনুভূতি’ কবিতাটি। নিঃসঙ্গতা যে কতটা কষ্টের, কতটা যন্ত্রণার তা এখানে স্পষ্টত, ‘নিরুপায় অনুকম্পা দুর্ভাবনার শিকলে আটকে ছটপট কল্পনার জগতে করুণ ট্রাজেডি কেউ শুনতে চায় না_ আত্মার অগণিত রহস্যঘেরা নিঃসঙ্গতা যাপনে ভরে উঠেছে অনুভূতির তীব্রতা।” পরিচিত শব্দের ব্যবহারে বিস্ময় ভঙ্গিমায় গেঁথে নিলেন আপন সুর। এ সুর বেদনার। একাকীত্বের মুহূর্মুহূ যাতনার। প্রতিটি নিঃসঙ্গ জীবনের অনুভূতিগুলো কেমন ব্যথাতুর হয় তা, কবি মিজানুর রহমান তোতার এ কবিতা না পড়লে উপলব্ধি করা যাবে না।
কবি মিজানুর রহমান তোতা’র এ যাবত কালের শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘আগুন কবি’ যা ইতিমধ্যে পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। কবিতায় উঠে এসেছে অন্যায়, অনৈতিক, শাসন-শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এক বিদ্রোহী সুর। কবি নিজেই বলেছেন “আমি একাই একশো” এই আমি সত্তা যেন সমগ্র বাঙালির যৌবনাসত্তা। একবিংশ শতাব্দীর এহেন দুর্দশা, সামাজিক অবক্ষয়, দুর্নীতি, রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত, সংশয়, দ্বিধা, অনিশ্চিয়তা, স্বাধীন দেশে পরাধীনতার দৈন্যতা ও অপরাজনীতি, অব্যবস্থা অনিয়ম দুর্নীতি হিংস্রতার বাড়াবাড়ি দেখে কবি চুপ করে থাকেননি। তিনি এই শৃঙ্খল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চান, লড়তে চান একা একাই, সঙ্গে কেউ থাকুক এ প্রত্যাশা কবির নেই। যুদ্ধের ময়দানে অত্যাচারীদের ধ্বংস করতে চান একাই। তিনি বর্তমান সমাজের নিপীড়িতদের আর্তনাদ শুনে জেগে উঠেছেন, অগ্নিক্ষরা ভাষায় করেছেন আপন বিদ্রোহের বাণী উচ্চারণ, “আমি আগুন কবি, হিংসা জ্বালিয়ে দিই, দর্প করি চূর্ণ, ঔদ্ধত্য অহংকার পদদলিত আমি রক্তচক্ষে দেই আঙুল, বিদ্বেষকে করি বিনাশ, আমি আগুনের আগুন কবি আমি আপোষহীন সংগ্রামী সমাজের দুর্নীতি, অন্যায় অপকর্মের বিরুদ্ধে রুখি আমি কারো পরোয়া করি না, কারো ধার ধারি না, নির্ভয়ে বুক ফুলিয়ে চলি।”
কবি মিজানুর রহমান তোতা নির্ভয়ে বুক ফুলিয়ে চলার দৃঢ়তা দেখিয়েছেন সবোর্চ্চ সাহসিকতায়। কবিতার ভাষা যেন শাণিত ক্ষুরধার। তিনি সব ধ্বংসের খেলায় মেতেছেন, অশান্ত, ক্ষিপ্ত হৃদয়ে বিদ্রোহ অবিচল।
নির্দ্বিধায় বলা যায়, একবিংশের যেন এক জীবন্ত নজরুল। কাব্যের অন্তরীক্ষে ব্যাপিত হয়ে আছে স্বচ্ছন্দ প্রবলয়াবেগ। মার্জিত ভাষার ওজস্বী মূর্ছনা অশ্রুতপূর্ব একঘেয়েমিমুক্ত শব্দশ্বৈর্যের সাথে গতিযুক্ত হয়েছে বা কাব্যগুণের ধারক ও বাহক। তিনি সুখ-দুঃখের সংসারে অনির্বচনীয়, অপার্থিবত্বের আস্বাদ গ্রহণ করেছেন। অনিত্যের খেলায় নিত্যের মাতম দেখেছেন। তিনি সুতীব্র ঝংকারে রচিলেন “প্রেমের অপমৃত্যু” কবিতা, “সব যুক্তিতর্ক আবেগ ছাপিয়ে প্রেমের বিকল্প সীমাবদ্ধতা উঠিয়ে মনকে ছেড়ে দিতে হবে যেখানে সেখানে যায় যাক।” এই যে বিকল্প ভাবনার অভিনবত্বের সীমানাহীনতার অভিলাষ তা নিখাদভাবে তুলে ধরতে কবি মিজানুর রহমান তোতা’য় পারেন। তাঁর সিদ্ধহস্তে ব্যঞ্জনায়ীত করতে কবিতার তেজস্ক্রিয়তা। “ফাল্গুনীর উল্লাস” কবিতায় কবি প্রকৃতিরূপী প্রেমিকাকেই যেন আহ্বান করেছেন। প্রেম আর প্রকৃতির কি এক অবাধ মেলবন্ধন কবিতার প্লট- উপমায়। কবিতার লাইনে আমরা দেখতে পাই, “হাটবো, কেউ থাকবে না সাথে মন ভরে দেখব।” এই আকাঙ্ক্ষা কবির আজন্ম লালিত। ধৈর্যের বাঁধভাঙা গান অনায়াসেই সুর তুলে যায়।
তিনি খুব ভালো করে জানেন যে প্রকৃতি কতটা আপন সুখানুভূতির ঠিকানায়। কবিতার পঙতিমালা মন দিয়ে না পড়লে, অনুভবে আনা বড্ড দায়, “দূরে আছি এই তো সুখ খোলামনে প্রকৃতির সাথে কথা বলছি মন দিয়ে শুনছি, নেই কোনো কৃত্রিমতা মেকি ভালোবাসা, নেই অন্তরে বিষ।” সত্যিই তাই, মানবের মন আজ বিষে পরিণত হয়েছে। আঘাতে আঘাতে তৃষ্ণার্ত হৃদয় করে ক্ষতাক্ত। তবুও কবি আশাবাদী সে আসবেই। কুয়াশার চাদর সরিয়ে প্রেয়সীর একদম কাছাকাছি হবেন। সুখের উল্লাসে তিনি নেচে উঠেছেন। কবি প্রেম চায়, দেহ না। তাইতো তিনি অকপটে বলে গেলেন, “দেহ দুলানোর নাচ স্মৃতিসিন্দুকে থাকুক।” কবির আশঙ্কা আর অভিমানের মাত্রা কতটা যে গভীর তা কবিতার শেষই প্রমা, “কিন্তু এই উল্লাস, নেশাতে লাল, আকর্ষণ থাকবে কতক্ষণ? বলতে পারো ফাল্গুনী? যতক্ষণ উত্তর দেবে না অপেক্ষা ততক্ষণ।” উত্তর পাওয়া না অবধি এই অভিমানের পালা শেষ হবার নয়। এই অপেক্ষায় শুধু কবিই নন, কবিরূপী হাজারো প্রেমিকের মন।
‘দিবানিশি স্বপ্নের খেলা’ কাব্যে ৮২টি কবিতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরো কিছু কবিতা হল, ‘খাম ভর্তি কান্নার চিঠি’, ‘হিংস্রতার বাড়াবাড়ি’, ‘দেয়াল ভাঙবই’, ‘বিপদকে আলিঙ্গন’, ‘সুখপাখির স্মৃতি’, ‘চেতনার সংলাপ’, ‘অহংবোধ’, ‘প্রেমসুধা’, ‘মাতোয়ারা’, ‘তবুও ভালোবাসবোই’, ‘ধূসর ভালোবাসায় সিক্ত’, ‘মৃত্যুছায়া’, ‘নির্ঘুম পথি’, ‘অশনী সংকেত’, ‘স্পর্শ অনুভূতি’। কবিতাগুলো কাব্যরসের বিমুগ্ধ অন্তপ্রাণ। কবি প্রকৃতি প্রেমিক। প্রকৃতির সৌন্দর্যে তিনি যেমন খুশিতে বিলীন তেমনি তার বিনাশে ব্যথিত। দুঃখভরা ক্লান্ত মন নিয়ে খাতার পাতায় লিখে গেলেন ‘সুন্দরবন কাঁদছে’ কবিতা। সুন্দরবনের রায়মঙ্গল, আড়পাঙ্গাসিয়া শিবসা, কালিন্দি, ছোট ছোট অসংখ্য খালবিলের কথাও তুলে ধরেছেন। সুন্দরী, গেওয়া, কেওড়া, বাইন আর গোলপাতার মত গাছগাছালি কেটে সাবাড়। উধাও হচ্ছে বনের সৌন্দর্যতা কাঁদছে সুন্দরবন। তিনি কবিতার শেষে ভীষণ আক্ষেপে বিক্ষুব্ধ সুরে লেখিলেন, “কাঁদছে, কান্না থামানোর নেই উদ্যোগ মৃত্যু পথযাত্রী বাংলার ঢাল বিশ্ব সুন্দরী সুন্দরবন।”
কবি মিজানুর রহমান তোতা বর্তমান সময়ের একজন আলোচিত কবিরত্ন। তিনি ‘দিবানিশি স্বপ্নের খেলা’ কাব্যের মাধ্যমে নির্জীব জাতির জীবনে আত্মোপলব্ধির গভীর ব্যঞ্জনা তুলে ধরেছেন। প্রেম, বিরহ, বেদনা, প্রকৃতির কোল, কোলাহল পূর্ণ জীবন, নীরবতা, অস্থিরতা, সহিংসতা সমস্ত কিছুর বাস্তবতা দৃশ্যায়ণ করেছেন নিপুণাস্থে। কাব্যের বিষয়ভাবনা চূড়ান্ত বিচারে মানবতার মুক্তি, প্রেম আর বেদনার বহিঃপ্রকাশ। আর এই বহিঃপ্রকাশই কবি মিজানুর রহমান তোতা ও তার কবি প্রতিভার সুপ্ত অভিপ্রায়।