স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা গৌরবময় আত্মদান করেছেন শহীদ আনোয়ার হোসেন আনু তাঁদের একজন। তিনি খুলনার রূপসা উপজেলার মুছাব্বরপুর গ্রামের সন্তান। ১৯৪৬ সালের ৩ মার্চ তার জন্ম। ৬৭ সালে এসএসসি পাশের পর সরকারি আযমখান কমার্স কলেজে ভর্তি হন। সে সময় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা বাঙালির বাঁচার দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। ছয় দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টি হয়। কলেজ জীবনের প্রথম থেকেই তিনি ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন।
১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন বিকম শেষবর্ষের ছাত্র। ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বর্বরতম আক্রমণ চালালে বাঙালি জাতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ২৬ মার্চ গোটা দেশজুড়ে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। খালিশপুরে তখন যুদ্ধ চলছে। রূপসা নদীর এপাড়ে বিভিন্ন দিক থেকে বাঙালি পিপিআর, পুলিশ, আনসার, ছাত্র ও শ্রমিক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। অস্ত্রের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এ সময় আনোয়ার হোসেন আনু এক দুঃসাহসিক অভিযানের পরিকল্পনা নেয়। কয়েকজন যুবক ভৈরব নদ পার হয়ে জেলা জজের বাসভবনের বাড়ির গাছ-গাছালি ঘেরা বাগানে প্রবেশ করে। সামান্য দক্ষিণে সার্কিট হাউজে আর্মি ক্যাম্প তখনও শক্তিশালী নয়। সার্কিট হাউজ থেকে বেশ দূরে উত্তর-পূর্ব কোনে আর্মি বাঙ্কারটাই তাদের লক্ষ্য। নির্জন পথে টহলরত একজন আর্মির দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে যান আনোয়ার হোসেন। পাকিস্তান সৈন্যকে পরাস্ত করে নদীর ঘাটে বেঁধে রেখে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে ফিরে আসনে বাঙ্কারে। তার কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়। সে অস্ত্র দিয়ে আরও তিনজন পাক সেনার কাছ থেকে তিনটি অস্ত্র কেড়ে নেয়। তারপর কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করে।
৭১’র মে মাস নাগাদ খুলনা সদর হাসপাতালের কম্পাউন্ডার নগেন্দ্রনাথ শীলের সহযোগিতায় ভারতে যান। তিনি ভারতে পৌঁছে টাণ্ডুয়া ক্যাম্পে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে সেপ্টেম্বর মাসে বিএলএফ সদস্যদের সাথে বারাকপুর ফিরে আসেন। বৃহত্তর খুলনা মুজিববাহিনীর প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকুর নির্দেশনায় সেপ্টেম্বরের শেষদিকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। প্রথমে দেবহাটা তারপর পাইকগাছা থানার হাতিয়ারডাঙ্গা গ্রামে আসেন। একপর্যায়ে মুজিববাহিনীর সদর দপ্তরে অবস্থান করেন।
ডিসেম্বরের প্রথমদিকে মুক্তিযোদ্ধারা কপিলমুনি ক্যাম্প দখলের পরিকল্পনা নেয়। এই যুদ্ধের অন্যতম যোদ্ধা আনোয়ার হোসেন আনু। আনোয়ারের অবস্থান ছিল কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্পের জন্য দেড়‘শ গজ উত্তরে জমিরখাল বাড়িতে। জমিরখাল বাড়ির দক্ষিণের দু’টো জানালা থেকে আনোয়ার হোসেন আনু ও সহযোদ্ধারা গুলি ছুঁড়তে থাকে। ইতিমধ্যে ৭ ডিসেম্বর রেডিও মারফত খবর হয় ৭ ডিসেম্বর যশোর সেনানিবাসে পাকবাহিনীর পতন হয়। কপিলমুনি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা বেড়ে যায়। আনু ও তাঁর সহযোগিরা জমিরখাল বাড়িতে ছাদ এবং জানালা থেকে কভারিং ফায়ার করতে থাকে। রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে শত্রুপক্ষের গুলিতে আনোয়ার হোসেন আনু আহত হয়। সহযোদ্ধারা তাকে নিরাপদ স্থানে নেয়ার চেষ্টা করে। চিকিৎসার জন্য তালায় নেয়ার পথে খেসরা গ্রামের ইউসুফ চেয়ারম্যানের বাড়িতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রথমে তাকে তালায় দাফন করা হলেও স্বাধীনতার পর গ্রামের বাড়ি রূপসা উপজেলার মুছাব্বরপুর গ্রামে দ্বিতীয় দফা দাফন করা হয়। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য তার অবদান অসামান্য।
খুলনা গেজেট / এআর