খুলনা, বাংলাদেশ | ২৩ আশ্বিন, ১৪৩১ | ৮ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  দেশে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১২১৮
  বিএনপি কর্মী খুনের মামলায় সাবের হোসেন ৫ দিনের রিমান্ডে
  সামিট গ্রুপের আজিজসহ পরিবারের ১১ সদস্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ

এতো পানির মধ্যেও সুপেয় পানির অভাব, মরছে মাছ

নিজস্ব প্রতিবেদক ও কয়রা প্রতিনিধি

চারিদিকে পানিতে থই থই। জোয়ারের সময় নদী আর ঘের-পুকুর বোঝার উপায় নেই। প্লাবিত হয়েছে লোকালয়। ঘরে মেঝে ও খাট সমান পানি। নিচু এলাকায় তা ছুয়েছে ঘরের ছাউনী পর্যন্তও। পানিতে ভেসে গেছে মাছের ঘের। নোনা পানিতে মরে ভেসে উঠেছে মিষ্টি পানির মাছ। ঘর ছেড়ে অনেকেই পাশ্ববর্তী উচু স্থানে এবং সাইক্লোন সেন্টারে আশ্রয় নিচ্ছে। অনেকেই জোয়ারের আগেই ঘর ছাড়ছে। আর ভাটার টানে ঘরে ফিরছেন। জোয়ার-ভাটা খেল‌ছে সেখা‌নে।

চারিদিকে এতো পানি, কিন্তু সুপেয় পানির অভাব রয়েছে। খাবার পা‌নির উৎস বন্ধ। নেই পর্যাপ্ত ওষুধ, খাবার স্যালাইন। আছে দূর্ভোগ। রান্না তো দূ‌রের কথা, ঘ‌রের চৌ‌কির ওপর থাকাও দুরূহ ব্যাপার। ফলে রোগ বালাই ছ‌ড়িয়ে পড়াসহ মান‌বিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে সেখানে। এমনটাই জানিয়েছেন কয়রা উপকূলীয় এলাকার মানুষ।

২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে খুলনার উপকূল কয়রার বিভিন্ন গ্রামের ঘরবাড়ি, মৎস্য ঘের, ফসলি জমি। এখনো জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম। বাজার-ঘাট খাওয়ার ব্যবস্থার কোনো ঠিক নেই। স্কুল-মাদরাসা, মসজিদ, বসতঘরে পানি প্রবেশ করেছে। প্রতিদিন জোয়ারে পানি উঠে যাওয়ায় বানভাসিদের সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।

মহারাজপুর ইউনিয়নের শিমলারাইট পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মুজিবুর রহমান বলেন, পানি রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি ও মসজিদে পর্যন্ত প্রবেশ করেছে। পুকুর ও ঘেরগুলো নোনা পানিতে ভেসে গিয়েছে। বিশেষ করে রুই, কাতলাসহ মিষ্টি পানির মাছ মরে ভেসে উঠেছে। মরা এসব মাছ থেকে দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না কি অবস্থা।

ওয়াল্ডভিশনের ফিল্ড ফেসিলেটর মো. আশরাফুল আলম বলেন, এখানে মাছের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। এটি মাছ চাষের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। বর্তমানে মাছ চাষের মৌসুম। লোনা পানি মিষ্টি পানির পুকুরে ঢুকে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে। আর নোনা পানির চিংড়ি মাছও ভেসে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পাশাপাশি ফসলি জমিরও ক্ষতি হয়েছে। নদীর পানি প্রবেশ করায় ঘর-বাড়ি তলিয়ে গেছে। মানুষ ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

দশহালিয়া গ্রামের বিকাশ চন্দ্র মৃধা বলেন, ঘর-বাড়ি ও মাছের ঘের ভেসে গেছে। মাছ মরে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানান তিনি।

গোবিন্দপুর গ্রামের আবুল হাসান বলেন, এই সময় মৎস্য চাষের একটা উপযুক্ত সময়। কিন্তু নদী ভাঙনে সবকিছু শেষ। একবছরেও টেকসই বাঁধ পেলাম না। যে কারণে সামান্য জোয়ারেও পানি প্রবেশ করছে। আমার ঘর-বাড়ি, ঘেরসহ সবকিছু শেষ।

গোবিন্দপুর ইসলামী যুবসংঘের সভাপতি মো. বায়জিদ হোসেন বলেন, জোয়ারের সময় ঘর-বাড়ি তলিয়ে যাচ্ছে। আর ভাটার সময়ও পানি থাকছে। অনেক স্থানে রান্না করার সুযোগ নেই। মাছের ঘের ও পুকুর ভেসে মিষ্টি পানির মাছ মরছে। পানি দূষিত হয়েছে।

তিনি বলেন, আজ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখেছি, সাইক্লোন সেল্টারে আশ্রয় নেওয়া মানুষের সাথে কথা বলেছি। এখানকার মানুষরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। আমাদের সংগঠনের সদস্যরা মাজা সমান পানি সাতরিয়ে বাড়ি বাড়ি যেয়ে রান্না করা খাবার দিয়েছে। তবে পর্যাপ্ত নয়। অনেকেই একবেলা খেয়ে অন্যবেলা না খেয়ে দিন পার করছেন। গরু-ছাগল, হাস-মুরগি এক ঘরে নিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, খাবার পানির তীব্র সমস্যা। টিউবওয়েলগুলো পানিতে ডুবে গেছে। অনেক কষ্টে পানি জোগাড় করতে হচ্ছে তাদের। মানুষের দূর্ভোগের শেষ নেই। ঠিকমতো ওষুধ কিনতে পারছে না। অনেকের ডায়রিয়া, চুলকানিসহ পানিবাহিত রোগ হচ্ছে।

মহারাজপুর ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের সদস্য মোস্তফা কামাল বলেন, দূর্ভোগের শেষ নেই। উপজেলার অধিকাংশ ইউনিয়নে পানিতে তলিয়ে যায়। জোয়ারের ঘর তলিয়ে যাচ্ছে। ভাটার সময় কিছুটা কমছে। তবে মাঝামাঝি লোকালয়ে যারা থাকে ভাটার টানে ওই এলাকার পানি কমে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। আমার এলাকায় কিছু উচু টিউবওয়েল রয়েছে সেটা থেকে পানি খাচ্ছে এই এলাকার মানুষ। তবে অন্য এলাকাগুলোতে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। হাটু পানি পেরিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে তাদের। সীমাহীন দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এখানকার মানুষের।

তিনি বলেন, মাছের ঘের-পুকুর তলিয়েছে। নোনা পানি প্রবেশ করায় অনেক স্থানে মাছ মরেছে। সেখান থেকে দূর্গন্ধও ছড়াচ্ছে।

কয়রা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এসএম আলাউদ্দিন জানান, উপজেলার সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর এলাকা তলিয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ১০০টি ঘের এবং ৭৫০টি পুকুর তলিয়ে গেছে। সবমিলিয়ে ২১ কোটি ৪৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

তিনি বলেন, মিষ্টি পানির পুকুরগুলোর মাছ মরে ভেসে উঠেছে। যেসব এলাকায় মাছ মরেছে সেখানে কিছুটা দুর্গন্ধও ছড়িয়েছে। মৎস্যখাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি জানান। সার্বিক বিষয় উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সুদীপ বালা বলেন, আশ্রয়কেন্দ্র গুলোতে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলয়েট, খাবার স্যালাইন, ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছে। কর্মী স্বল্পতা রয়েছে ১১৭ টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। ফিল্ডে কর্মী রয়েছে ৫২ জন। এই জনবল দিয়ে উপজেলায় কাজ করতে হচ্ছে। তাদের নিজেদের বাড়িতেও পানি প্রবেশ করেছে। তবুও চেষ্টা করা হচ্ছে। কয়রা উপকূলীয় এলাকার মানুষ লবনপানিতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পুকুর এবং নলকূপের পানি খেয়ে অভ্যস্ত তারা।

তিনি বলেন, উপজেলা প্রশাসন ও জনস্বাস্থ্যপ্রকৌশল পানি সরবরাহ করছে। ফলে বড় ধরনের কোন সমস্যা হচ্ছে না। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু এলাকায় ডায়রিয়া হতে পারে। তবে প্রকোপ আকার ধারণ করেনি।

খুলনা গেজেট/ এস আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!