সরকারি পাটকলের উৎপাদন বন্ধের একটি বছর পেরিয়ে গেল। বন্ধের ৬ মাসের মধ্যে ফের চালুর কথা থাকলেও এক বছরেও চালু হয়নি। এমন অভিযোগ শ্রমিক ও নেতাদের। তবে এখনও আশায় বুক বেঁধে রয়েছে শ্রমিকরা। মিল বন্ধ এবং লকডাউনে বেকাদায় পড়েছে শ্রমিকরা। ২০২০ সালের বছর ১ জুলাই মিলগুলো বন্ধের পর লিজের মাধ্যমে আবার চালু করার ঘোষণা দিয়েছিল বিজেএমসি। কিন্তু লিজের মাধ্যমে পাটকলগুলো আবার কবে চালু হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছে শ্রমিকরা। এ অবস্থায় খুলনার খালিশপুর শিল্পা ল ছেড়ে অনেক পরিবার বিভিন্ন জেলায় গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে মিলের যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত থাকায় নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এক বছর ধরে কর্মহীন প্লাটিনাম জুট মিলের স্থায়ী শ্রমিক জাহাঙ্গীর হোসেন (৫৫)। তিনি জানালেন, তার পাওনা ছিল ৮ লাখ ২১ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৪ লাখ টাকা নগদ পেয়েছেন, বাকি ৪ লাখ টাকার স য়পত্র দিয়েছে। কিন্তু স য়পত্র ভাঙাতে পারছেন না। সব টাকা নগদে পেলে তা দিয়ে ছোটখাট কোনো ব্যবসা করতে পারতেন। মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে কাজের জন্য চেষ্টা করলেও কোনো কাজ জোটেনি। মিলের ২ নং গেট এলাকার ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি। পরিবারের ৭ সদস্য নিয়ে এখন তার দুর্ভোগে দিন কাটছে।
প্লাটিনাম জুট মিলে ২৬ বছর কাজ করতেন স্থায়ী শ্রমিক মোঃ জালাল। তিনি জানান, মিল চালু থাকলে তিনি আরও ১৩/১৪ বছর কাজ করতে পারতেন। মিল বন্ধ হওয়ার পর তিনি পাওনা ৪ লাখ টাকা পেয়েছেন, বাকি ৪ লাখ টাকা কবে পাবেন তা অনিশ্চিত। কেউ এখন আর তাকে কাজে নেয় না। ফলে স্ত্রী ও ৪ ছেলে-মেয়ে নিয়ে অভাব-অনটনে রয়েছেন। ৪ ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া করে, তাদের খরচ চালাতে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন।
শুধু এই দুইজনই নয়, তাদের মতো দুর্ভোগে রয়েছেন বন্ধ হয়ে যাওয়া খুলনা অ লের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলের প্রায় ৪১ হাজার শ্রমিক পরিবার। কেউ কেউ অন্য পেশায় ঢুকলেও অনেকের জোটেনি কোনো কাজ। বন্ধের পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও পাটকলগুলো আর চালু হয়নি। লিজের মাধ্যমে পাটকলগুলো চালু করার কার্যক্রম চলছে ধীরগতিতে।
বিজেএমসির খুলনা আ লিক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, খুলনার আলীম, ক্রিসেন্ট, ইস্টার্ন, প্লাটিনাম ও স্টার এবং যশোরের কার্পেটিং ও জেজেআই জুট মিলে স্থায়ী শ্রমিক ছিল ১৪ হাজার ৯৮৭ জন। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৪ জন তাদের পাওনা নগদ প্রায় ৪৩ কোটি টাকা এখনও পায়নি। এছাড়া ৯ হাজার ৪৮১ জন শ্রমিক তাদের পাওনা প্রায় ৪৯২ কোটি ৬০ লাখ টাকার স য়পত্র এখনও পায়নি। শ্রমিকদের অর্ধেক টাকা নগদ এবং অর্ধেক টাকা স য়পত্রের মাধ্যমে প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিল বিজেএমসি।
এছাড়া এই ৭টি পাটকলের ২১ হাজার ৩৫১ জন বদলি শ্রমিকের পাওনার পরিমাণ ১১৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। কিন্তু বদলি শ্রমিকদের কেউ এখনও কোনো টাকা পায়নি। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত খালিশপুর জুট মিলের ৪ হাজার ৪৭৪ জন ও দৌলতপুর জুট মিলের ৩৫০ জন শ্রমিক দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করতেন। মিল বন্ধ হওয়ার কারণে তারা কোনো আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন না।
পাটকলের বদলি শ্রমিক নেতা ইলিয়াস হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এক বছর পেরিয়ে গেলেও বদলি শ্রমিকরা পাওনা টাকা পায়নি। কবে দেওয়া হবে তাও অনিশ্চিত।
পাটকলের আরেক বদলি শ্রমিক নেতা আবদুর রাজ্জাক তালুকদার বলেন, মিল বন্ধের পর তিনি ইজিবাইক চালানো শুরু করেন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনে এখন ইজিবাইক চলাচলও বন্ধ। ফলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খেয়ে-না খেয়ে দিন কাটছে।
পাটকল শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক মোঃ খলিলুর রহমান বলেন, শ্রমিকরা তাদের বকেয়া সব টাকা পায়নি। অধিকাংশ শ্রমিকের নতুন কর্মসংস্থানও হয়নি। ফলে চাকরিহারা পাটকল শ্রমিকরা কেউই ভালো নেই। মিল আবার চালু করার প্রতিশ্রæতি থাকলেও তাতে অগ্রগতি হচ্ছে না।
তবে বিজেএমসির খুলনা আ লিক সমন্বয়কারী মোঃ গোলাম রব্বানী জানান, পাটকলগুলো লিজ দিতে বিজেএমসি গত ২৭ এপ্রিল আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করেছিল। গত ১৭ জুন নির্ধারিত সময়ে ক্রিসেন্ট, স্টার, দৌলতপুর, কার্পেটিং ও জেজেআই জুট মিল লিজ নিতে আবেদন জমা পড়েছে। কিন্তু প্লাটিনাম, খালিশপুর ও স্টার জুট মিল লিজ নিতে কোনো আবেদন জমা পড়েনি। আর আলীম জুট মিল আপাতত লিজের তালিকায় নেই।
বিজেএমসির চেয়ারম্যান মোঃ আবদুর রউফ জানান, যেসব আবেদন জমা পড়েছে সেগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। লিজের মাধ্যমে পাটকল আবার চালু করা হবে, তবে সে জন্য আরও সময় লাগবে।