উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট নিরসন ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের দাবি জানিয়েছে সাতক্ষীরার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘উত্তরণ’। একই সাথে সরকারের প্রতি নব প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও গবেষণার অাহবান জানানো হয়েছে। বৃহষ্পতিবার (২৪ জুন) সকালে উত্তরণ’র সাতক্ষীরার কলারোয়া প্রজেক্ট অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উত্তরণ এর পরিচালক শহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংস্থাটির প্রজেক্ট এন্ড এডভোকেসি অফিসার (পি.ও টি এন্ড এ) শেখ রুসায়েদ উল্লাহ। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের উপকূলীয় অঞ্চল তথা সাতক্ষীরা, খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালী জেলা দুর্যোগপ্রবণ অতি ঝুঁকিপূর্ণ জেলা। এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো সুপেয় পানির সংকট। এ এলাকার ৬৭ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে প্রায় ৫৫ লক্ষ অধিবাসী এ সমস্যা দ্বারা আক্রান্ত। সুপেয় পানি সংকটের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরণের দুর্যোগ ও জলাবদ্ধতার সময় এ এলাকার স্যানিটেশন ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।
সংবাদ সম্মেলনে আরো জানানো হয়, এই এলাকার ভূমি গঠন ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় না নিয়ে সরকার দেশের অন্যান্য অংশের মতই এই অঞ্চলেও গভীর ও অগভীর নলকূপ নির্ভর প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। খাবার পানির সংকট সমাধানের জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রতি বছর অর্থ বরাদ্দ করে থাকে। কিন্তু এলাকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ভিন্নতর হওয়ার কারণে সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ এবং পানীয় জলের সংকট নিরসনে ব্যবহৃত এ সকল প্রযুক্তি খুব একটা কাজে লাগে না। কিন্ত অতীব দুঃখের বিষয় সমস্যাটি সমাধানের জন্য এই পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে বড় ধরণের কোন গবেষণা বা হাইড্রোলজিক্যাল সার্ভে করা হয়নি।
উত্তরণ পরিচালিত এক গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ৭৯% নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে যা স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর। এছাড়া ব্যাপকভাবে নোনা পানির চিংড়ী চাষের কারণে এলাকায় লবণাক্ততার তীব্রতা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে উপকূলীয় বাঁধের পূর্বে এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ সংরক্ষিত পুকুরের পানি পান করত। কিন্তু চিংড়ী চাষ স¤প্রসারণের ফলে লবণাক্ততার কারণে ঐসব পুকুরগুলোর পানি ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। তাছাড়া ভূ-গর্ভস্থ পানিতেও লবণাক্ততার মাত্রা তীব্রতর হচ্ছে। ফলে উপকূল অঞ্চলে খাবার পানি সংগ্রহ করা বিশেষ করে মহিলাদের জন্য বড় ধরণের একটি কঠিন কাজ। এক কলস খাবার পানি সংগ্রহের জন্য ২ থেকে ৫-৬ কিমি দূরে যেতে হয়, দাঁড়াতে হয় দীর্ঘ লাইনে। দিনের একটা বড় অংশের শ্রম ঘন্টা ব্যয় হয় এ কাজে। তারপরও যে পানি সংগ্রহ করা হয় বা ক্রয় করা হয় সেটা চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। খাবার পানি ছাড়া গৃহস্থলী সহ অন্যান্য সকল কাজে লবণাক্ত বা দূষিত পানি ব্যবহার করা হয়।
তিনি আরো বলেন, খাবার পানির সংকটের সুযোগ নিয়ে অসংখ্য ব্যবসায়ী খাবার পানি বিক্রির সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে। এসব ব্যবসায়ীদের ব্যবহৃত প্রযুক্তি অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশ সম্মত নয়। এই প্রক্রিয়ায় পরিশোধিত পানিতে বিভিন্ন খনিজ লবনের ঘাটতি রয়েছে। বাজারজাত এসব পানি পরীক্ষা করার জন্য বিভিন্ন ধরণের সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থাকলেও মাঠ পর্যায়ে তাদের কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না। তদুপরি দরিদ্র মানুষদের পক্ষে বাজারজাত উচ্চ মূল্যের এসব পানি কিনে খাওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। যার ফলে তারা অনিরাপদ পানি পান করে থাকে যে কারণে বিভিন্ন রকমের পেটের পীড়া, আমাশয়, ডায়রিয়া, জন্ডিস সহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হয়।
শেখ রুসায়েদ উল্লাহ অভিযোগ করে বলেন, যেখানে দেশের অধিকাংশ মানুষের সুপেয় পানি সংকটের সমাধান হয়েছে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এবং তারা বিনামূল্যেই এই সেবা রাষ্ট্র থেকে পেয়ে থাকে। কিন্তু সেখানে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অধিকাংশ জনগণ সুপেয় পানির চাহিদা পুরণ করে বাজার থেকে পানি কিনে অথবা অনিরাপদ পানি পান করে যা বৈষম্যমূলক। তিনি এসব সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের জোর দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, ভূগর্ভে জলাধারের অবস্থা কোথায় কেমন সে বিষয় ব্যাপক ভিত্তিক একটি বড় ধরনের অনুসন্ধান করতে হবে। দরিদ্র, হতদরিদ্র, প্রতিবন্ধি, দলিতশ্রেনী ও নারী প্রধান ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন থাকতে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে। সুপেয় পানির জন্য প্রচলিত প্রযুক্তি যেহেতু এ এলাকার জন্য উপযোগি নয় এজন্য নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এলাকার দীঘি, খালসহ সকল ধরনের পানির আধার গুলো দখল ও দূষনমুক্ত করে সংরক্ষনের ব্যবস্থা গ্রহণ ও নতুন কওে আরো পুকুর ও দীঘি খনন করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উত্তরণ পরিচালকের পিএস গাজী জাহিদুর রহমানের সভাপতিত্বে আরো উপস্থিত ছিলেন প্রোগ্রাম ম্যানেজার হেদায়েত উল্লাহ মুকুল, ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মোঃ রিয়াজুল ইসলাম ও ফিল্ড ফ্যাসালিটর (এফ.এফ) রাহুল দে প্রমুখ।
খুলনা গেজেট/ টি আই