এক সময় শরীরে তেজ ছিল, ছিল যৌবনের ছোঁয়া। সেই শরীরই এখন অসাড়। মাথা গোঁজার ঠাঁই জোটেনি। একটি দুর্ঘটনা সবকিছু শেষ করে দিয়েছে। যাদের জন্য এক সময়ে জীবনের সবকিছু দিয়েছেন, তারা এখন আর খোঁজও নেয় না। প্রিয়তমা স্ত্রী অনেক আগেই ছেড়ে গেছে। ছিলেন ছেলের কাছে! সেই ছেলের কাছে অসাড় দেহের বাবার প্রয়োজনও ফুরিয়েছে। তাই আশ্রয় হয়েছে সড়কে। শরীরের যন্ত্রণার সাথে তাই মনের যন্ত্রণাও কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে সোনালী জুট মিলের মেকানিক্যাল বিভাগের সাবেক শ্রমিক আব্দুল জব্বার (৬৬) কে।
মহানগরীর খানজাহান আলী থানার বাদামতলা বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র (বিটাক)’র সামনে রোড ডিভাইডারে এখন আব্দুল জব্বারের একার সংসার। গেল ১৫ দিন এখানেই শুয়ে তাঁর দিন কাটছে। পথচারীরা করুণা করে কেউ কিছু দিলে তাঁর মুখে খাবার জোটে। না হলে উপোস থাকতে হয়।
আব্দুল জব্বার বলেন, বছর তিনেক আগে ইজিবাইক দুর্ঘটনায় বাম হাত হারান। এরপর কোনভাবে কাটছিল গত তিন মাস আগে সকালে ঘুম থেকে জেগে দু’পা নড়োতে পারছিলাম। ভেবেছিলাম, রগে টান লেগেছে- ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কোনভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। এরপর খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হই। কয়েকদিন পর সেখানে ডাক্তাররা কিছু চিকিৎসা দিলেও সুস্থ হয়নি। তারা (ডাক্তার) আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। আমি ডাক্তারদের বললাম, আমার তো টাকা পয়সা নাই। উনারা বললেন, সরকারি ওষুধ নাই তোমাকে কি দিব? আশ্রয় নিয়েছিলাম ছেলের কাছে। ছেলে কিছুদিন দেখার পর একদিন আমাকে একটা ভ্যান ডেকে বাসা থেকে বের করে দেয়। এখন আমি ফুটপাতে শুয়ে দিন কাটাচ্ছি। বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে পারিনা। দু ‘পায়ের ভিতর কামড়ায়। কিছুক্ষণ পর পর শরীরের পেশীকে টান লাগে। সহ্য করতে পারিনা। তাই চিৎকার করি। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই।
জব্বার জানান, দেশ স্বাধীনের পূর্বে বাবার হাত ধরে বরিশালের ভান্ডারিয়া উপজেলার নদ মোল্লা গ্রাম থেকে মানিকতলা ভাড়া বাসায় উঠি। এরপর কর্মক্ষম হওয়ার পর সোনালী জুট মিলে মেকানিক্যাল শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করি । দীর্ঘদিন মিলে কাজ করার পর হঠাৎ মিলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়ি। কপালে দুশ্চিন্তার চাপ পড়ে। কি করে পেটের খাবার যোগাবো? কি করে স্ত্রী, দুই সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিবো? কোন উপায়ান্ত না পেয়ে টুকটাক ব্যবসা শুরু করি। সংসারে দারিদ্রতার কারণে স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে যায়। মেয়েকে পাত্রস্থ করি। একমাত্র ছেলে মারুফ থাই গ্লাসের কাজ শুরু করে। ভেবেছিলাম এবার হয়তো ভাল থাকবো। কিন্তু আমার আর ভাল থাকা হলোনা।
‘ছেলের সাফ কথা আমি তোমাকে দেখতে পারবো না। আমার কাজ কাম নাই। তুমি অন্যখানে যেভাবে পারো খাও।’ আদরের একমাত্র ছেলে একটা ভ্যান ডেকে বাড়ি থেকে বের দেয়।
বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) দুপুরে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় রোড ডিভাইডারের উপর শুয়ে ছটফট করছেন আব্দুর জব্বার। কিছুক্ষণ পর পর তার পায়ের পেশীতে টান পড়ছে, আর ‘মাগোরে, আল্লাহ’ বলে চিৎকার করছেন। তিনি আকুতি করে বলেন, আমারে যদি কেউ একটু ডাক্তারখানায় নিয়ে যেতো, আমার পা দু’টো যদি সুস্থ করে দিতো, আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া আদায় করতাম।
খুলনা গেজেট/কেডি